শান্তির জন্য একটি সমাজের স্থায়িত্ব এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। এই স্থায়িত্ব নির্ভর করে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং নিরাপত্তা ও সুরক্ষার মতো মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির পূরণের উপর। অর্থনৈতিক অথবা সামাজিকভাবে যাঁরা নিম্নস্তরে বাস করেন তাঁদের, উচ্চস্তরে বাস করেন যাঁরা, তাঁদের দ্বারা শোষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অসাম্য কমিয়ে আনতে পারলেই এই শোষণ একভাবে দূর করা যায়। দারিদ্র্য দূর করা এবং সকল মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ নিশ্চিত করার মতো বিশ্বস্তরে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নীতি প্রণয়নের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এর ফলেই যাঁদের আছে আর যাঁদের নেই, তাঁদের মধ্যের যে ফারাক, তা কমিয়ে আনা সম্ভব।
কেমনভাবে আমরা তা পারব? পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের উচিত এক সাহচর্য গড়ে তুলে সম্পদের এক বিশ্বব্যাপী ভাগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে সহ-অবস্থান ও সহ-উন্নয়ন দুই-ই চলতে পারে। আগামী কয়েক দশক শক্তি, পরিস্রুত জল ও পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে একটি বিশ্বব্যাপী সংকট থাকবে। বহ রাষ্ট্রকেই এগিয়ে এসে একযোগে একটি ভিশন তৈরি করতে হবে, যাতে পরবর্তী প্রজন্মের তরুণরা সুখে শান্তিতে বাস করতে পারেন। যখন কোনও রাষ্ট্রের সামনে নির্দিষ্ট মিশনের একটি ভিশন থাকে, তখন আতঙ্কবাদ ও হিংসার মতো সমস্যা নির্মূল হয়ে যায়।
.
পনেরো : ‘পুরা’-র গুরুত্ব
এক সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে যদি আমাকে একটি সুনির্দিষ্ট মিশনের কথা বলতে হয় যেটি বহুদূর যেতে সক্ষম, আমি সেই তৃণমূল স্তরের মিশনের কথা বলব যা আমার হৃদয়ের বড় কাছের— ‘পুরা’। এর সম্পর্কে আমি এই বইয়ে আগে ছুঁয়ে গিয়েছি, কিন্তু আমি এখানে তার সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা করতে চাই। কারণ, আমি মনে করি এই সময়ের চাহিদা পূরণে এটি আদর্শ। ভারত থেকে শুরু করে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রে, এই প্রকল্প সকলকে নিয়ে বৃদ্ধি এবং সুসংহত উন্নয়ন আনতে সক্ষম।
‘পুরা’-র সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত
ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এক দেশে রূপান্তরিত হতে হলে তার ৬০০,০০০ গ্রামে উন্নয়ন সব থেকে জরুরি। তার অর্থ:
১। গ্রামগুলিকে নিজেদের মধ্যে এবং বড় বড় শহর ও মেট্রো শহরের সঙ্গে ভাল রাস্তা ও রেললাইনের মাধ্যমে যুক্ত থাকতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণ ও বহিরাগতদের জন্য অন্যান্য পরিকাঠামো যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য বন্দোবস্ত থাকতে হবে। একে আমরা বলতে পারি সরাসরি সংযোগ।
২। জ্ঞানের স্ফুরণের যুগে, স্থানীয় জ্ঞানের সংরক্ষণ করে তার ব্যাপ্তি আনতে হবে আধুনিক প্রাযুক্তিক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে। উৎকৃষ্ট শিক্ষার নাগাল পেতে হবে গ্রামগুলিকে, শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের কাছ থেকে তা তিনি যেখানেই থাকুন, পেতে হবে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবা, তেমনই জেনে নিতে হবে কৃষি, মাছচাষ, ফুলচাষ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো বিষয়ে সাহায্যর কথা। এর অর্থ গ্রামগুলির বৈদ্যুতিন সংযোগ থাকতে হবে।
৩। ভৌত সংযোগ এবং বৈদ্যুতিন সংযোগ থাকলেই জ্ঞানের সংযোগ ঘটে যাবে। এর ফলে উৎপাদন বাড়বে, অবসর সময়ের ব্যবহার বাড়বে, স্বাস্থ্য কল্যাণ বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে, উৎপাদনের বাজার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, এবং গুণগত মান সম্পর্কে বোধ এবং স্বচ্ছতা বাড়বে।
৪। এই তিন সংযোগ ঘটলেই রোজগার বৃদ্ধির ক্ষমতা বাড়বে।
সুতরাং, মিশন হিসেবে ‘পুরা’, গ্রামগুলিকে সমৃদ্ধশালী জ্ঞানের কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে দিতে পারে। গ্রামের মানুষকে করে দিতে পারে উদ্যোগপতি। হিসেব বলছে ভারতের জন্য ৭০০০ ‘পুরা’ কমপ্লেক্স প্রয়োজন তার ৬০০,০০০ গ্রামের জন্য যেখানে ৭০ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের বসবাস। সেইভাবে ৩০,০০০ পুরা কমপ্লেক্সের প্রয়োজন সারা বিশ্বের ৩ বিলিয়ন গ্রামীণ অঞ্চলকে এক অর্থনৈতিকভাবে উদ্যমী অঞ্চলে পরিণত করতে এবং সেই সঙ্গে স্থায়ী উন্নয়ন নিয়ে আসতে।
‘পুরা’ চালু করতে ভারত সরকার ১,৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে, জাতীয় স্তরে বিভিন্ন জেলায় কাজ শুরু করে দিয়েছে পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ মডেলে। বেশ কয়েকটি কর্মক্ষম ‘পুরা’ চালু করেছে বেশ কিছু শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রতিষ্ঠান এবং তার সঙ্গে শিল্প মহল। তেমন কয়েকটি প্রকল্প হল তামিলনাডুতে পেরিয়ার ‘পুরা’, মহারাষ্ট্রে লোনি ওয়ারানা ভ্যালি ‘পুরা’ এবং চিত্রকূট ‘পুরা’ মধ্য প্রদেশে।
‘পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড
আমি এবার, “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’ নামের একটি অনন্য স্থায়ী উন্নয়নের ব্যাবসায়িক উদ্যোগ-চালিত মডেল উপস্থাপন করতে চাই। “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর মূল ভাবনাটা হল যে, পরবর্তী প্রজন্মের ‘পুরা’ উদ্যোগের ভাবনার মধ্যে রাখতে হবে যে, তাঁদের মানুষের জীবনধারণের ব্যবস্থাপক হয়েই শুধুমাত্র কাজ করলে হবে না, আরও কিছু করতে হবে। একটি ‘পুরা’ কমপ্লেক্সের গ্রামীণ জনসাধারণের সার্বিক, সুসংহত উন্নতি হল “পুরা’ অ্যাক্টিভেটেড’-এর লক্ষ্য। তার সঙ্গে আর একটি লক্ষ্য হল, স্থায়ী সামাজিক-ব্যাবসায়িক মডেলের মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্যোগপতিদের এক উল্লম্ব সংহত নেটওয়ার্ক রচনা করা, যাতে তাঁরা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করে পরস্পরের মূল্যমান বৃদ্ধি করেন। যার ফলে, সকল স্টেকহোল্ডারই হবেন লাভবান।