শ্রীধরণের দিল্লি মেট্রোর কাজ এতটাই সফল ছিল এবং ভারতের কাছে তার গুরুত্ব ছিল এতটাই যে ফ্রাঁস তাঁকে Chevalier de la Legion d’honneur (নাইট অফ দ্য লিজিওন অফ অনার) সম্মানে ২০০৫ সালে ভূষিত করে, এবং ভারত সরকার তাঁকে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম নাগরিক সম্মান পদ্মবিভূষণে সম্মানিত করে ২০০৮ সালে। তিনি ২০০৫ সালের শেষে অবসর নেবেন বলে ঘোষণা করেন, কিন্তু তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় দিল্লি মেট্রোর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। দিল্লি মেট্রোর সঙ্গে ষোলো বছরের কর্মজীবনের পর তিনি অবসর নেন ৩১ ডিসেম্বর ২০১১। অবসরের পর তিনি সামান্যই বিশ্রাম পেয়েছেন, কারণ তাঁকে কোচি, লখনউ, জয়পুর, বিশাখাপট্টনম এবং বিজয়ওয়াড়ার মেট্রোর কাজে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত করে নেওয়া হয়।
বিশ্ব নেতৃত্ব
এঁদের মতো নেতারাই ভারতকে শ্রেষ্ঠ করে তুলে ধরছেন এবং আগামীতেও তুলে ধরবেন। কিন্তু আমি প্রায়ই বলে থাকি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য রেখে এগোনো একটি অপরাধ। সুতরাং আমরা এক শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র গড়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি না। এটি একটিই পৃথিবী যা সমগ্র মানবসমাজ ভাগ করে নেয়, তাই আমাদের লক্ষ্য হবে একে এক মহান গ্রহে পরিবর্তন করা।
আমি এখানে এক দূরদ্রষ্টা আধ্যাত্মিক নেতা শ্রীঅরবিন্দর স্বপ্নের কথা বলতে চাই। তাঁর প্রথম স্বপ্নটি ছিল এক বৈপ্লবিক অভিযানে ভারতকে মুক্ত করা এবং সংযুক্ত করা। ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭-এ তা সম্ভব হয়েছে। দ্বিতীয় স্বপ্নটি ছিল এশিয়ার মানুষের পুনরুত্থান এবং মুক্তি। তার সঙ্গে, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে ভারতকে তার পুরনো মহান ভূমিকায় ফিরে যেতে হবে। তাঁর তৃতীয় স্বপ্ন ছিল, সমগ্র মানব জাতির জন্য সত্যনিষ্ঠ, উজ্জ্বল এবং অভিজাত জীবনের জন্য এক বিশ্বব্যাপী সংযুক্তিকরণে ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন।
অন্য বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে হাতে হাত রেখে ভারতকে এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে। সকলকে নিয়ে একটি বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবে ন্যায়নিষ্ঠ, সমৃদ্ধ এবং শক্তিশালী পৃথিবী। আমি মনে করি তিনটি লক্ষ্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ:
১। এক আলোকোজ্জ্বল সমাজ: এক সমৃদ্ধিশালী শান্তিপূর্ণ বিশ্বের প্রয়োজনে মূল্যবোধ সম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি।
২। শক্তি ব্যবহারে স্বাধীনতা: এক পরিচ্ছন্ন বসুন্ধরা পাওয়ার যে স্বপ্ন আমরা প্রত্যেকেই পোষণ করি তাকে বাস্তবায়িত করা।
৩। বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের মঞ্চ: সকল রাষ্ট্রের দক্ষতাকে মিলিত করে সংকটপূর্ণ সমস্যাগুলির সমাধান করা, যেমন জলের অপর্যাপ্ততা, সকলের জন্য ভাল মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ক্ষমতার নির্মাণ।
আমাদের সত্যিকারের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য অভিযান এখনও শেষ হয়নি। সে কাহিনি আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে। পৃথিবীর পরিবেশ আজ বিপজ্জনক, এবং ভারতের স্বাধীনতা, যা বহু যন্ত্রণা ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে এসেছিল, তাকে সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করতে হবে, তাকে শক্তিশালী করে প্রসারিত করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতার খোঁজ চলবে ক্রমাগত। কঠিন ও দ্রুত কাজের ভিতর দিয়ে সে খোঁজ চলবে এমনভাবে যাতে স্বাধীন ও নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের বিবর্তন ত্বরান্বিত হয়।
ভারত একটি তরুণ রাষ্ট্র এবং সে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে আমরা তাত্পর্যপূর্ণ এক রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন করতে পেরেছি। প্রাকৃতিক রোষ, কয়েকটি যুদ্ধ এবং সীমান্তপারের আতঙ্কবাদের মতো নানান পরীক্ষা এবং ক্লেশের মধ্যে দিয়েই ঘটেছে এই উন্নয়ন। এবং এসবই হয়েছে আমাদের জনসংখ্যা ও রাজনীতির সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই। এতসত্ত্বেও, সবুজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বনির্ভরতা এসেছে এবং আমাদের একশো কোটি মানুষের খাদ্য সংস্থান আমরা করতে পেরেছি। গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রের উন্নতির মাধ্যমে গড় আয়ুর বৃদ্ধি করতে পেরেছি আমরা। আমাদের শিল্প ভিত প্রসারিত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পেয়েছে নতুন উদ্যম। উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তিতে, অন্তরিক্ষ, আণবিক শক্তি এবং প্রতিরক্ষা গবেষণায়।
কিন্তু কোনও রাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী সংযোগ আজ একান্তই বাস্তব এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব শান্তি আর সমগ্র মানবজাতির উন্নয়ন নিশ্চিত হলে এক নিরাপদ বিশ্বের সৃষ্টি হবে যেখানে সকল রাষ্ট্রই হবে লাভবান। দারিদ্র্য দূরীকরণ, শক্তির নিশ্চয়তা, পানীয় জলের লভ্যতা এবং পরিবেশ রক্ষা হল আজ মানবজাতির সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। বহু রাষ্ট্রকে ভুগতে হয় সীমান্ত পারের আতঙ্কবাদ এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য। এটি শুধু কোনও একটি দেশ বা অঞ্চলের সমস্যা নয়— এ আজ সারা বিশ্বের সুখ শান্তিকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে।
সারা পৃথিবীতে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব, ক্রোধ ও হিংস্রতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে ঐতিহাসিক শত্রুতা, স্বৈরশাসন, অবিচার, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মের মৌলবাদ। এই সব মিলিয়ে আতঙ্কবাদের বিস্ফোরণ ঘটছে আজ সারা বিশ্বে। এক সুখ শান্তির পৃথিবী নির্মাণের প্রয়োজনে আমাদের যেতে হবে এই সবের মূলে যে সমস্যা, তার মোকাবিলায়। সেগুলি হল দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং বেকারত্ব।