এই ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা পেলাম তা হল, একজন সত্যিকারের নেতা সকল সময়ে সাফল্যের গৌরব যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের দেন, আর অসাফল্যের দায় নেন নিজে। একেই বলে নেতৃত্ব। ভারতের বিজ্ঞান জগতের সৌভাগ্য যে, তেমন নেতৃত্বই সে পেয়েছে। এবং তার ফল হয়েছে তার বহু কৃতিত্ব।
যে-সব তরুণরা আগামী দিনের নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। যে মহান পাঠটি আমরা পেলাম তা হল, সত্যিকারের নেতা তা তিনি রাজনীতি, প্রশাসন, বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প, বিচারব্যবস্থা বা মানব-সংক্রান্ত অন্য যে ক্ষেত্রেই হোক, তাঁর ভিতর মননশীলতা যেমন থাকবে তেমনই অসাফল্যকে স্বীকার করে নেওয়ার ক্ষমতাও থাকতে হবে, এবং সাফল্যের কৃতিত্ব তাঁর দলের সদস্যদের দিতে হবে।
ড. ব্রহ্ম প্রকাশ: ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্য
যে নেতা সম্পর্কে এবার বলতে চাই তিনি ধাতুতত্ত্ববিদ ড. ব্রহ্ম প্রকাশ, যিনি আণবিক বস্তু নিয়ে কাজের জন্য খ্যাত। আমি যখন এসএলভি-৩-এর প্রোজেক্ট ডিরেক্টর, ড. প্রকাশ তখন ছিলেন বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের অধিকর্তা। ভারতে অন্তরিক্ষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির জন্য তিনি অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি আমার মনে করতে ভাল লাগে, তা হল, যে মুহূর্তে এসএলভি-৩ প্রকল্পটি অনুমোদন পেল, বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের বিভিন্ন ল্যাবরেটরি এবং ইসরো-র বিভিন্ন কেন্দ্র, সঙ্গে স্পেস ডিপার্টমেন্ট, সকলে একত্রে একটি দল হিসেবে কাজ করতে থাকল লক্ষ্যে পৌঁছনোর তাগিদে। ১৯৭৩ থেকে ’৮০, এই সময়টায় বিশেষ করে, মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা, সঙ্গে অন্যান্য ছোট ছোট প্রকল্পের দাবির সঙ্গে যুঝতে হচ্ছিল। কিন্তু তিনি ব্যবস্থা করলেন যাতে যাবতীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত কাজ এসএলভি-৩ এবং তার উপগ্রহে নিয়োজিত হয়।
আমি বলেছি ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্যর জন্য ড. প্রকাশ বিখ্যাত। এর কয়েকটি উদাহরণ দিই। রোহিণী উপগ্রহকে অক্ষে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য এসএলভি-৩ প্রকল্পটিতে প্রথমবারের জন্য তিনি নিয়ে এলেন এক সুসংহত ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা। এসএলভি-৩ ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনা আমার টাস্ক টিম রচনা করার পর তিনি স্পেস সায়েন্টিফিক কমিটির প্রায় পনেরোটি চিন্তন বৈঠক করলেন তিন মাসে। বহু আলোচনার পর এই ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনাটি ড. প্রকাশ সই করে দেন, এবং তা হয়ে দাঁড়ায় সমগ্র সংস্থাটির নির্দেশাবলি। এটি ছিল জাতীয় দূরদৃষ্টিকে কর্মকাণ্ডের নানান যোজনার রূপে নিয়ে আসার শুরুও।
এই ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থার পরিকল্পনার উদ্ভাবনের সময়ে আমি খেয়াল করলাম নানা ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী মতামত। বহু ব্যক্তি এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে নিজেদের ব্যক্তিসত্তাকে হারাবার ভয়ে, মিটিংগুলিতে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। কিন্তু ড. প্রকাশ তাঁর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সারাক্ষণ বজায় রাখতেন। মানুষের ক্রোধ, ভয় এবং সংস্কার, সব অদৃশ্য হয়ে যেত এই মানুষটির চিন্তার আভিজাত্যে।
আজ ইসরো-তে অন্তরিক্ষ যোজনাগুলি, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলি এবং উৎক্ষেপণ অভিযানগুলি এক সুসংহত ও সহযোগিতামূলক আবহে হচ্ছে। এই মহান মহাত্মাটির কাছে আমি শিখেছি যে, কোনও প্রকল্প শুরুর আগেই একটি প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান সঠিকভাবে প্রণয়ন করে তাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা আবশ্যক। সেই প্ল্যানে থাকবে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ, কেমনভাবে বিভিন্ন পর্যায় এগোতে হবে, কেমনভাবে আগে থেকেই আসন্ন কঠিন অবস্থার বিষয়ে সতর্ক হয়ে তা সমাধানের ব্যবস্থা করে নিতে হবে— যার মধ্যে সময়, কার্যকারিতা এবং সূচি হচ্ছে সব থেকে জরুরি। ম্যানেজমেন্টে আভিজাত্য নিয়ে আসার জন্য তাঁকে সাধুবাদ।
ই শ্রীধরন: আবেগ নিয়ে লক্ষ্য পূরণ
‘মেট্রো মানব’ ই শ্রীধরন হলেন ইদানীংকালের এক নেতা যাঁকে ভারত পেয়েছে। নিজের ভিশনকে প্যাশন দিয়ে এক মিশনে রূপান্তর করে কোটি কোটি মানুষের জীবন পালটে দেওয়ার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত এই মানুষটি। প্রথমে কোঙ্কান রেলওয়ে এবং পরে দিল্লি মেট্রোর মাধ্যমে ভারতের সরকারি পরিবহণের চিত্রটিই তিনি পালটে দিয়েছেন।
বহু বাধা সত্ত্বেও কোঙ্কান রেলওয়ে প্রকল্পটি সাত বছরে শেষ হয়। তার পথের ৮২ কিমি. অংশে রয়েছে তিরানব্বইটি টানেল। নরম মাটি কেটে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। তার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ৭৬০ কিমি. এবং রয়েছে ১৫০টিরও বেশি ব্রিজ। এটি এমন এক সরকারি প্রকল্প যার জন্য অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ তেমন তাত্পর্যের নয়, এবং সময়সীমাও বৃদ্ধি না করেই সম্পন্ন করা হয়। এটি তাই এক বিরাট এবং অভূতপূর্ব কৃতিত্ব বলে মানা হয়।
দিল্লি মেট্রো রেল কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর করে দেওয়া হয় তাঁকে। ঘোষিত বাজেট ও সময় মেনেই সব ক’টি নির্দিষ্ট কাজ শেষ হয় তাঁর নেতৃত্বে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সময়ের আগেই শেষ হয় কাজ। তিনি তাঁর প্রকল্পের কাজ রাজনৈতিক চাপ এবং প্রভাব মুক্ত রাখার জন্য খ্যাত ছিলেন। তিনি তাঁর প্রকল্পের কাজকে দ্রুত শেষ করার জন্য রাজনৈতিক মহল থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতেন। তাঁর প্যাশন এবং ভিশন ভারতকে তার প্রথম সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থা দিয়েছিল। ১৫০টি স্টেশন এবং ২০০ কিমি. দৈর্ঘ্যের দিল্লি মেট্রো বিশ্বে দ্বাদশতম বৃহৎ মেট্রো ব্যবস্থা। ২৬ লক্ষ মানুষকে সে প্রতিদিন পরিসেবা দেয়। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপুঞ্জ কার্বন ক্রেডিট দিয়ে শংসাপত্র দিয়েছে একে— বিশ্বের প্রথম মেট্রোরেল এবং রেললাইনভিত্তিক ব্যবস্থা যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকে হ্রাস করে শহরের দূষণের মাত্রাকে হ্রাস করেছে।