মহাত্মা গাঁধী, ড. নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকা
কিছু বছর আগে আমার এক অনন্য অভিজ্ঞতা আমাকে দেখিয়ে দিল যে, এক বিপুল জনজাতিকে কীভাবে একটি মানুষ উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। দিল্লিতে হঠাৎ-ই আমার সুযোগ হল মহাত্মা গাঁধীর প্রপৌত্রী, শ্রীমতি সুমিত্রা গাঁধী কুলকার্নির সঙ্গে সাক্ষাতের। তিনি তাঁর পিতামহ, যাঁকে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁর বিষয়ে একটি ঘটনার কথা আমাকে শোনালেন।
গাঁধীজি প্রতি সন্ধ্যায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর প্রার্থনাসভাটি করতেন। প্রার্থনার শেষে হরিজন উন্নয়নের জন্য দান সংগ্রহ করা হত। তাঁর সহকারীরা প্রতিদিন তা গুনে রাখতেন এবং তাঁর রাতের আহারের আগে তাঁকে মোট অঙ্কটি জানিয়ে দেওয়া হত। পরের দিন ব্যাঙ্কের আধিকারিক এসে তা ব্যাঙ্কে নিয়ে যেতেন। একদিন আধিকারিকটি জানালেন যে, সংগৃহীত অর্থ এবং তাঁকে যে টাকা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কয়েক পয়সার গরমিল রয়েছে। পার্থক্যটি নেহাতই ক্ষুদ্র অঙ্কের। কিন্তু গাঁধীজি জোর দিয়ে বললেন যে, সংগৃহীত অর্থ যেহেতু গরিবদের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাই তার প্রতিটি পয়সার সঠিক হিসেব থাকা প্রয়োজন। এমনই ছিল গাঁধীজির নৈতিক সততার পথ। সেই পথেই তিনি সমগ্র দেশবাসীকে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন মহত্ত্বের অভিমুখে। তাঁর উদাহরণ মেনে আমাদের প্রত্যেকের উচিত আমাদের চিন্তায় ও কাজে এই নৈতিক সততার অভ্যাস করা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের একটি প্রাচীন ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় আমার ভ্রমণের একটি বৃত্তান্ত আমি এখানে বর্ণনা করব। একের পর এক স্টেশন পার হয়ে ট্রেনটি ঝিকঝিক করে এগোতে লাগল; আর অবিচারের বিরুদ্ধে সেই দেশে গাঁধীজির সংগ্রামের কথা আমার মনে পড়তে থাকল। আমি পিয়েটারমারিটসবার্গ স্টেশনে, যেখানে নামলাম, সেইখানেই গাঁধীজিকে তাঁর চামড়ার বর্ণের জন্য প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। দেখলাম, সেখানে তাঁকে স্মরণ করে একটি স্মৃতিফলক:
এই ফলকের কাছেই কোনও স্থানে
এম কে গাঁধীকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল
একটি প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে
৭ জুন ১৮৯৩ রাত্রে।
এই ঘটনা তাঁর জীবনের ধারাকে
পরিবর্তিত করে দিয়েছিল।
তিনি বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে
লড়াই শুরু করেন।
তাঁর সক্রিয় অহিংস্রতার
শুরু এই দিনটি থেকে।
সেখানে দাঁড়িয়ে আমার মন চলে গেল দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার দু’টি পূর্ব অভিজ্ঞতার স্মৃতিতে। একটি হল রোবেন দ্বীপে, যেখানে ড. নেলসন ম্যান্ডেলাকে সাতাশ বছর একটা ছোট্ট কুঠুরিতে অন্তরিন করে রাখা হয়েছিল। অন্যটি ড. ম্যান্ডেলার বাড়িতে।
টেবল পর্বতের জন্য কেপ টাউন খুবই বিখ্যাত। এই পর্বতমালার তিনটি শিখর— টেবল পিক, ডেভিল পিক আর ফেক পিক। শিখরগুলি দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। সারাদিন ধূসর আর সাদা মেঘ এক একটি শিখরকে যেন আলিঙ্গন করে শিখরগুলির মধ্য দিয়ে উড়ে বেড়ায়। টেবল পিকটি সমুদ্রতটের সব থেকে কাছের শিখর। সেখান থেকে দশ মিনিটে আমি রোবেন দ্বীপে পৌঁছে যাই হেলিকপ্টারে। সমুদ্রর গর্জন বাদে সেই দ্বীপ একেবারে শান্ত, নিশ্চুপ। এইখানেই ব্যক্তির স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছিল।
বিস্মিত হতে হয় ড. ম্যান্ডেলার কুঠুরিটির পরিমাপ দেখে। এক ছ’ফুট দীর্ঘ মানুষের পক্ষে সাতাশ বছর ধরে ওই ক্ষুদ্র কুঠুরিতে শোয়া-থাকার কথা ভাবা যায় না। প্রতিদিন প্রখর সূর্যের আলোয় কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁকে নিকটবর্তী পাহাড়ে খনন কাজে নিয়ে যাওয়া হত। এই সময়েই তাঁর দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হয়। কিন্তু শারীরিকভাবে নির্যাতিত হলেও, তাঁর অন্তরাত্মা ছিল অজেয়। ওয়ার্ডেন শুয়ে পড়লে, তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে লিখে যেতেন তাঁর পাণ্ডুলিপি, যা পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয় একটি বিখ্যাত গ্রন্থের আকারে, Long Walk to Freedom.
জোহানেসবার্গে তাঁর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল আমার কাছে এক বিরাট ঘটনা। ছিয়াশি বছরের মানুষটি হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে কী অসাধারণ অভ্যর্থনা জানালেন। বিদায়ের সময়ে তিনি আমাকে এগিয়ে দিতে পোর্টিকো পর্যন্ত এলেন। তাঁর হাতের লাঠিটি তিনি পরিত্যাগ করে আমাকে ভর করে হাঁটলেন। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ড. ম্যান্ডেলা, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলনের মুখ্য ব্যক্তিরা কারা ছিলেন?’
তাঁর তাত্ক্ষণিক উত্তর, ‘অবশ্যই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন এম কে গাঁধী। ভারত আমাদের এম কে গাঁধীকে দিয়েছিল, আর দু’দশক পর আমরা ভারতকে ফিরিয়ে দিলাম মহাত্মা গাঁধীকে।’ ভারতের ঐতিহ্যই তো তাই। আমরা যে দেশেই গিয়েছি আমরা তাদের সাহায্য করেছি— অর্থনৈতিকভাবেই শুধু নয়, জ্ঞান, শ্রম, এবং সর্বোপরি মান ও সম্মান দিয়ে।
ড. ম্যান্ডেলা যখন দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি হলেন, তিনি তাঁর দেশবাসীকে, যারা তাঁর সঙ্গে অসদাচরণ করেছিল, সাতাশ বছর অন্তরিন করে রেখেছিল, তাদের তিনি দিলেন স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সমঅধিকার। সুপ্রিয় বন্ধুগণ, ২২০০ বছর আগে কবি-সন্ন্যাসী তিরুভাল্লুভারের লেখা তিরুক্কুরালের দু’টি চরণ, ড. ম্যান্ডেলার কাছে প্রাপ্ত শিক্ষার যেন প্রতিফলন: