‘ওহে বিক্রম, তুমি তো বাচ্চাদের গৃহ, আমার গৃহ এবং ঈশ্বরের গৃহ চাইতে এসেছ,’ বললেন বিশপ। ‘সে কী করে সম্ভব?’
উভয়েরই একটি বিষয়ে মিল ছিল। কঠিন সময়েও তাঁরা দুজনেই হাসতে পারতেন। বিশপ, ড. সারাভাইকে রবিবার সকাল ৯টায় গির্জায় আসতে বললেন। ড. সারাভাই আর তাঁর দল তা-ই গেলেন। তাঁরা যখন গির্জায় পৌঁছলেন তখন প্রার্থনা চলছিল। প্রার্থনার শেষে বিশপ, ড. সারাভাইকে মঞ্চে ডেকে নিলেন।
‘প্রিয় সন্তানবৃন্দ, ইনি একজন বিজ্ঞানী, ড. বিক্রম সারাভাই,’ তিনি তাঁর শ্রোতাদের বললেন। ‘বিজ্ঞান কী করে? আমরা সকলেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আলো জ্বালাই, এমনকি এই গির্জায়ও। আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি এই মাইকের মাধ্যমে, যা প্রযুক্তির দান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্যে রুগিদের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা হয়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির সাহায্যে মানবজীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং তার মান বৃদ্ধি করেছে। যাজক হিসেবে আমি কী করি? আপনাদের সুখ শান্তির জন্য প্রার্থনা করি। ছোট করে বলতে গেলে, বিক্রম আর আমি একই কাজ করি। বিজ্ঞান আর অধ্যাত্মবাদ উভয়ই সর্বশক্তিমানের কাছে মানবজাতির শারীরিক ও মানসিক সমৃদ্ধির জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। প্রিয় সন্তানেরা, বিক্রম বলছে এক বছরের মধ্যে তটরেখার কাছেই আমাদের এই ব্যবস্থার বিকল্প তৈরি করে দেবে। প্রিয় সন্তানেরা, আমরা কি আপনাদের আবাস, আমার আবাস, ঈশ্বরের আবাস বিজ্ঞানের এক মহান কর্মকাণ্ডের জন্য দিয়ে দিতে পারি?’
নিশ্চুপ স্তব্ধতা সব দিকে। তারপর সকলে, যাঁরা সেদিন গির্জায় সমবেত হয়েছিলেন, উঠে দাঁড়িয়ে একযোগে বলে উঠলেন, ‘আমেন।’
গির্জার জায়গায় আমরা তৈরি করলাম আমাদের ডিজ়াইন কেন্দ্র, যেখানে আমরা শুরু করলাম রকেট অ্যাসেমব্লির কাজ। বিশপের বাড়িটি হল আমাদের বিজ্ঞানীদের কর্মস্থান। সেইখানেই আমরা চালু করলাম থুম্বা ইকুয়েটোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন, যা পরবর্তী সময়ে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার হিসেবে স্থাপিত হয়। ওইখানে অন্তরিক্ষ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের সূত্রপাত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্পেস সেন্টারের স্থাপনা হতে লাগল। গির্জাটি বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে হাজার হাজার মানুষ জানতে পারছেন ভারতের অন্তরিক্ষ গবেষণার অত্যন্ত ক্রিয়াশীল ইতিহাস। এর সঙ্গে তাঁরা জানতে পারছেন এক বিজ্ঞানী এবং এক অধ্যাত্মবাদী নেতা, এঁদের দু’জনের মহৎ চিন্তা-ভাবনার খবর। থুম্বার বাসিন্দারা বিকল্প স্থানে পেলেন তাঁদের নতুন স্কুলবাড়ি এবং আরাধনার স্থান।
এই ঘটনাটি যখনই স্মরণে আসে, আমি দেখি কেমন করে আলোকপ্রাপ্ত আধ্যাত্মিক জগতের এবং বিজ্ঞান জগতের নেতারা একযোগে মানবকল্যাণে কাজ করেন। থুম্বা ইকুয়েটোরিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন এবং পরবর্তীতে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারের জন্ম দেশকে লঞ্চ ভেহিকল, অন্তরিক্ষ যান এবং অন্তরিক্ষ প্রয়োগ সংক্রান্ত দক্ষতা এনে দিল। এবং তার ফলে ভারতের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়ে এক অভাবনীয় স্তরে পৌঁছয়।
আজ আমাদের মধ্যে না আছেন ড. সারাভাই, না আছেন ফাদার পেরেরা, কিন্তু তাঁরা আমাকে ভগবদ্গীতার এই পঙ্ক্তিগুলি মনে করিয়ে দেন: ‘ফুলকে দেখ কেমন উদারভাবে সুগন্ধ ও মধু বিতরণ করছে। সে সকলকেই তা দিচ্ছে, দিচ্ছে তার ভালবাসা। কাজের শেষে সে চুপিসারে ঝরে যায়। ফুলের মতো হও— নানা গুণ সত্ত্বেও নিরভিমান।’ কী অসাধারণ এই বার্তা মানবজীবনের ধর্ম বিষয়ে।
অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান: সাফল্য ও অসাফল্য সমানভাবে স্বীকার করা
তিন দশক আগে, আমি যখন ইসরো-তে কাজ করছি, আমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা পেয়েছিলাম যা কোনও বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারবে না। ইসরো-র তদানীন্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান আমাকে একটি কাজ দিলেন। প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান এসএলভি-৩ নির্মাণ করে রোহিণী উপগ্রহকে কক্ষপথে পাঠাতে হবে। এটি ছিল সেই সময়ে সব থেকে উচ্চপ্রযুক্তির অন্তরিক্ষ যোজনা। সমগ্র অন্তরিক্ষ প্রযুক্তি সমাজ প্রস্তুত এই কর্মকাণ্ডের জন্য। হাজারও বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রযুক্তিবিদ দিনরাত কাজ করে ১০ অগাস্ট ১৯৭৯-এ এসএলভি-৩-কে উৎক্ষেপণ করা গেল।
এসএলভি-৩ আকাশে উঠল ভোর বেলা। প্রথম পর্যায়টি আমরা পেরিয়ে গেলাম মসৃণভাবে। সবক’টি রকেট এবং সিস্টেমগুলি ঠিকঠাক কাজ করলেও প্রকল্পটি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারল না কারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ সিস্টেমটির কাজ ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কক্ষে ঢোকার পরিবর্তে রোহিণী গিয়ে ডুবল বঙ্গোপসাগরে। মিশনটি হল অসফল।
অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীহরিকোটায় সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপক ধাওয়ান আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করলেন যে, এই অসাফল্যর দায়ভার তাঁরই। কিন্তু আমি ছিলাম প্রোজেক্ট ডিরেক্টর এবং মিশন ডিরেক্টর। পরের বছর, ১৮ জুলাই ১৯৮০, এসএলভি-৩ উৎক্ষেপণ করে আমরা যখন সাফল্যের সঙ্গে রোহিণীকে কক্ষপথে নিক্ষিপ্ত করতে পারলাম, একটি সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। এইবার অধ্যাপক ধাওয়ান আমাকে সামনে ঠেলে দিয়ে সাফল্য কাহিনির অংশীদার করে সংবাদমাধ্যমের সামনে উপস্থিত করলেন।