সাহিত্য জগতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কার পেলেন ১৯১৩ সালে। যে সময়ে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল দূর অস্ত্, সেই সময়ে তিনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর দেশবাসীকে স্বাধীনতার জন্য দৃঢ় বিশ্বাস ও আবেগ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছেন:
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,…
পিতঃ, ভারতেরে সেই স্বাধীনতার স্বর্গে করো জাগরিত
[Where the mind is without fear and the head is held high…
Into that heaven of freedom, my Father, let my country awake.]
সেই সময়েই, মহান তামিল কবি, জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী সুব্রাহ্মনিয়া ভারতী তাঁর দূরদৃষ্টিতে এক মহান ভারতকে দেখলেন, যেখানে স্ত্রীজাতি মুক্ত ও যেখানে শিক্ষার বিস্তার হয়েছে। ১৯১০ সালে তিনি স্বাধীনতার জয়গানের এক কবিতায় বললেন, ‘চল সবে উৎসবে মাতি, আমাদের আনন্দময় স্বাধীনতা এসে গিয়েছে।’ সংগীতের ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতকে ত্যাগরাজা, মুথুস্বামী দীক্ষিতার এবং শ্যাম শাস্ত্রীর ত্রিমূর্তি কর্ণাটকি সংগীতকে সমৃদ্ধ করে তুললেন। পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সংগীতে নবজাগরণ নিয়ে এলেন।
এই সময়ে ভারত বেশ কয়েকজন অনুপ্রাণিত মহিলা নেত্রীকে পেয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের ভীমা বাঈ হোলকার, কিট্টুরের রানি চেন্নাম্মা, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, ঔধের বেগম হজরত মহল, আর বিংশ শতকে সরোজিনী নাইডু, কস্তুরবা গাঁধী এবং অ্যানি বেসন্তের মতো কয়েকটি নাম আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়, তাঁদের অবদানের জন্য— যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক বা রাজনীতিতে।
সবশেষে বহু মহান নেতা যেমন পণ্ডিত জহরলাল নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বোস, সর্দার বল্লভভাই পটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং সি রাজাগোপালাচারি, মহাত্মা গাঁধীর অনুপ্রাণিত নেতৃত্বে স্বাধীনতা অভিযানের সামনের সারিতে থেকে ভারতকে এনে দেন তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতা।
বিক্রম সারাভাই: এক মহান দূরদ্রষ্টা
স্বাধীনতার পর ভারত বহু মহান নেতার দেখা পেয়েছে। এঁদের অনেকের সঙ্গেই কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বিমুগ্ধতা নিয়ে আমি স্মরণ করি তেমনই একজনকে— ড. বিক্রম সারাভাই। ইসরো-তে সাত বছর আমি তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। তাঁর এক-পৃষ্ঠার বিখ্যাত এক বক্তব্যে আমি দেখেছিলাম ভারতের অন্তরিক্ষ যোজনার উন্মেষ।
তাতে বলা হয়েছে: ‘তার বিশাল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানভাণ্ডার ও যুবশক্তির আধার নিয়ে ভারতের নিজস্ব রকেট সিস্টেম সমূহ (স্যাটেলাইট লঞ্চিং ভেহিকল) নির্মাণ করা জরুরি, এবং তার সঙ্গে নির্মাণ করা উচিত তার নিজস্ব যোগাযোগ, রিমোট সেন্সিং এবং আবহবিদ্যাগত নভোযান, এবং নিজস্ব ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, যাতে উপগ্রহ যোগাযোগ, রিমোট সেন্সিং এবং আবহবিদ্যা ভারতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্তরিক্ষ প্রকল্পে যে কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়েছে তার সবই সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য।’
এই মহান নেতা যিনি ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে কাজ করা আমার কাছে এক দুর্দান্ত শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। এই চার দশক পর যখন আমি সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্যটি ফিরে দেখি, আমি বিস্মিত হয়ে যাই তার অভীষ্ট ফল দেখে। আজ ভারত যে-কোনও উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান, যে-কোনও নভোযান তৈরি করতে সক্ষম, এবং তাদের উৎক্ষেপণ হয় ভারতীয় ভূমি থেকেই। চন্দ্রযান ও মঙ্গলযান উৎক্ষেপণ করেছে ভারত। অন্য গ্রহে মানুষ পাঠানোর তোড়জোড় চলছে। ভারত প্রমাণ করেছে নভোবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা কার্যকরী যোগাযোগ, সম্পদ ম্যাপিং, বিপর্যয়ের ভবিষ্যবাণী এবং তার ম্যানেজমেন্ট প্রদান করতে সক্ষম।
ড. সারাভাই ভারতের জন্য এমন এক পথের দিশা দেখিয়েছেন যা কেউ কোনওদিন ভাবতে পারেননি। আমি একটি বিশেষ ঘটনার কথা বলতে চাই যা তাঁর এই বৈশিষ্ট্যটিকে প্রকাশ করেছে। ১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে তিনি আর তাঁর দল মিলে অনেকগুলি বিকল্প জায়গা দেখে একটি জায়গা নির্বাচন করেন যেটি অন্তরিক্ষ গবেষণার জন্য প্রযুক্তিগতভাবে উপযোগী। উচ্চ বায়ুমণ্ডলে আয়নোস্ফেরিক ও ইলেক্ট্র্রোজেট গবেষণার জন্য আদর্শ যে চৌম্বক বিষুবরেখা, তার কাছেই অবস্থিত বলে নির্বাচিত হল কেরালার থুম্বা।
নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি বিশেষ স্থান খুঁজে পাওয়া ছিল ড. সারাভাইয়ের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথা অনুযায়ী কেরালা প্রশাসনের কাছে তিনি প্রথমে গেলেন। জায়গাটির এবং তটরেখার প্রোফাইল দেখে জানানো হল যে সেখানে হাজারো মত্স্যজীবীর বাস। সেখানে রয়েছে একটি প্রাচীন গির্জা, বিশপের বাড়ি ও একটি স্কুল। সুতরাং প্রশাসনের মনে হয়েছে জায়গাটি এই কাজে দেওয়াতে সমস্যা হবে। বিকল্প হিসেবে অন্য কোনও জায়গা ব্যবস্থা করে দিতে তাঁরা প্রস্তুত। জানানো হল যে, একজনের সঙ্গে দেখা করতে, যিনি এই ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন।
তিনি হচ্ছেন ওই অঞ্চলের বিশপ রেভারেন্ড ফাদার পিটার বার্নার্ড পেরেরা। আমার মনে আছে, এক শনিবার বিকেলে ড. সারাভাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সেই সাক্ষাৎটি হয়ে দাঁড়াল ঐতিহাসিক। আমরা অনেকেই ছিলাম প্রত্যক্ষদর্শী।