বালকের এই প্রশ্ন সকলের সাদর অভিনন্দন পেল। এক লক্ষ তরুণ আমার কাছে উত্তর চায়। মঞ্চে উপবিষ্ট বন্ধুরাও আমার দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে। কিছু পল চিন্তা করে আমি ছেলেটির নাম জানতে চাইলাম।
সে উত্তর দিল, ‘বিনীত।’
আমি বললাম, ‘বিনীত, তোমার রয়েছে এক শক্তিশালী মন এবং তুমি দেশকে ভালবাস। তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে পারি, একথা সত্য যে, চিনের অর্থনৈতিক উন্নতি ভারতের থেকে ভিন্ন ধরনের। কিন্তু চিনের সঙ্গে তফাত হল, ভারত এক সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ। তার জনগণ নেতাদের নির্বাচন করেন। গণতন্ত্রের কিছু চাপ, কিছু টান থাকে। কিন্তু আমাদের পাখা মেলে এগিয়ে যেতে হবে। ওই দীর্ঘসূত্রতা যা গণতন্ত্রের সহচর, তাকে দূর করার দায়িত্ব নিতে হবে নেতৃত্বকেই। এখানে যত তরুণ আজ জমা হয়েছেন, তাঁদের আমি বলব, প্রিয় তরুণ সাথীরা, আমি আপনাদের দু’টি ব্যবস্থা— একটি পূর্ণ গণতন্ত্র, সঙ্গে দ্রুত উন্নয়ন, এবং অন্যটি চিনের মতো রাজনৈতিক ব্যবস্থা— এই দু’টি ব্যবস্থার মধ্যে আপনারা কোনটি বেছে নেবেন?’
হাত তুলে যখন আমি তাঁদের পছন্দ জানাতে বললাম, ৯৯ শতাংশ তরুণ হাত তুলে জানালেন, তাঁরা দ্রুত উন্নয়নের গণতন্ত্রে বাস করতে চান। এই বার্তাটি উচ্চস্বরে এবং স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিল: ‘তরুণ সমাজ নিশ্চিত করে চায় নতুনভাবে আবিষ্কৃত হোক এক দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্র।’
আমি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আমাদের গণতন্ত্রকে পুনরাবিষ্কার করে আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের পথটিকে পালটে দেবার জন্য আহ্বান করব। আমি শেষ করব আমাদের সাংসদদের জন্য এই শপথ দিয়ে:
১। আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কারণ আমার নির্বাচন কেন্দ্র আমাকে নির্বাচিত করেছে তাঁদের নেতৃত্ব দেবার জন্য।
২। আমি উপলব্ধি করছি যে জনগণের নেতৃত্বের অর্থ আমার নির্বাচন কেন্দ্রতে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে হবে।
৩। আমার নির্বাচন কেন্দ্রের জন্য আমার লক্ষ্য হবে: ১০০ শতাংশ শিক্ষিত করে তোলা, সব জলাধারগুলিকে কার্যকরী করা, সকল প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রগুলিতে সত্ত্বর কাজ শুরু করা, এবং সর্বোপরি, এক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কেন্দ্র।
৪। আমি প্রশ্ন করব, ‘আমি কী দিতে পারি?’ এই প্রশ্ন আমাকে বিনয়ের সঙ্গে পরিসেবা দিতে বাধ্য করবে।
৫। আমি সততার সঙ্গে কাজ করব এবং সফল হব সততার সঙ্গে।
৬। আমি ২০ লক্ষ গাছ রোপণ করে নিশ্চিত করব আমার নির্বাচন কেন্দ্রতে সবুজ পরিবেশ।
৭। আমার মেধা সকল যন্ত্রণা দূর করুক।
৮। জাতীয় পতাকা আমার হৃদয়ে সর্বক্ষণ উড্ডয়নরত এবং আমি আমার রাষ্ট্রকে এনে দেব গরিমা।
৩. অন্তিম কিছু ভা
পর্ব ৩ : অন্তিম কিছু ভাবনা
চোদ্দ : নেতৃত্বের গুরুত্ব
আমি সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে অনুরোধ করব এই শপথগুলি অনুধাবন করে সেগুলিকে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে। তাহলেই আমরা সকল ক্ষেত্রেই মননশীল নেতৃত্ব পাব, যে নেতৃত্ব আমাদের রাষ্ট্রকে পথ দেখিয়ে সেই শ্রেষ্ঠত্বের দিকে নিয়ে যাবে। নেতৃত্বের গুরুত্বের বিষয়ে আমি বলে সেভাবে ঠিক বোঝাতে পারব না কারণ, তাদের একটিমাত্র লক্ষ্যই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেয়। ভারতের ইতিহাস থেকে কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নিয়ে আমরা দেখি কেমন ভাবে কয়েকজন নেতা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে এনেছিলেন আমূল পরিবর্তন।
স্বাধীনতা অভিযান
ভারতের স্বাধীনতা অভিযান রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, শিল্পকলা, বিচারব্যবস্থা, বিজ্ঞান এবং শিল্পের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন জন্ম দিয়েছে বেশ কয়েকজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, নিয়োজিত ও আবেগপ্রবণ নেতার। রাজনীতির ক্ষেত্রে বাল গঙ্গাধর টিলক ১৮৮০-র দশকে উচ্চারণ করলেন অগ্নিসম তাঁর সেই উক্তি, ‘স্বাধীনতা আমার জন্মগত অধিকার, এবং তা আমি আদায় করবই’, এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সঞ্চার করলেন নতুন জীবন। জামশেদজি টাটা ভারতে লৌহশিল্পের সূত্রপাত করলেন, যদিও সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসকরা তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করেছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, আর বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির স্থাপনা করলেন পণ্ডিত মদন মোহন মালব্য ১৯১৬ সালে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির রসায়নের অধ্যাপক আচার্য পি সি রায় ছিলেন ভারতে ফার্মাসিউটিকালের পুরোধা পুরুষ।
ভারতীয়-মার্কিনি অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট অধ্যাপক সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর, যিনি ১৯৮৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন, তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, কেমনভাবে ১৯২০ দশকে পাঁচ পাঁচজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ভারতে কাজ করছিলেন। এঁরা হলেন সি ভি রমন, জে সি বোস, শ্রীনিবাস রামানুজন, এস এন বোস এবং মেঘনাদ সাহা। চন্দ্রশেখর বলছেন, এটা এক সুখকর কাকতালীয় ঘটনা নয়। এঁরা প্রত্যেকেই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, ভারতীয় মেধা বিশ্বের যে-কোনও শ্রেষ্ঠ মেধার সমতুল। তিনি আরও বলেছেন, স্বাভিব্যক্তি এবং নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করার এক দুর্দমনীয় অভিপ্রায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে থাকে, তা সে রাজনীতিতেই হোক বা বিজ্ঞানে, এবং তা স্বাধীনতা অভিযানে প্রতীয়মান হয়েছে।