আমরা তাঁর দপ্তরে পৌঁছে দেখলাম ফাইলটি তাঁর সামনে রাখা। তিনি বললেন, ‘কালাম, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওখানকার পাঁচটি দ্বীপই আমি আপনাকে (ডিআরডিও)-কে বিনা ব্যয়ে দেব। কিন্তু আমি ফাইলে সই করব যদি আপনি একটা প্রতিজ্ঞা রাখেন।’
আমি চিন্তা করতে লাগলাম এই শক্তিশালী নেতাটি আমার কাছে কী চাইতে পারেন।
তিনি আমার হাতটি ধরে বললেন, ‘চিন যাবার একটি আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমি সেখানে যাব যদি আপনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, এমন একটি মিসাইল আপনারা নির্মাণ করবেন যা চিনে গিয়ে পৌঁছবে।’
‘স্যার, আমরা অবশ্যই সেই দিকে কাজ করব,’ আমি বললাম। তিনি ফাইলে সই করে দিলেন।
ইন্দিরা গাঁধী এবং বিজু পট্টনায়কদের মতো নেতাদের দূরদৃষ্টি দু’দশক পরে ২০১২ সালে সম্ভব করেছে আমাদের বিজ্ঞানীদের আণবিক-ক্ষমতাসম্পন্ন ‘অগ্নি ৫’ নির্মাণে, যার রেঞ্জ ৫০০০ কিমি.।
সাংসদদের প্রতি ডাক
আমি যখন ভারতের সাংসদদের দিকে তাকাই, আমি তাঁদের মধ্যে দেখতে পাই পি ভি নরসিংহ রাও ও অটলবিহারী বাজপেয়ী, ইন্দিরা গাঁধী ও বিজু পট্টনায়ক, বা ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, পণ্ডিত জহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, সর্দার বল্লভভাই পটেল, ড. বাবাসাহেব অম্বেদকর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং মহাত্মা গাঁধীর প্রতিশ্রুতি। তাঁরা ছিলেন ভারতের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃবর্গ। আজকের সাংসদদের আমি প্রশ্ন করতে চাই: আপনারাও কি হতে পারেন না দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সেই সব নেতা, যাঁরা রাষ্ট্রকে নিজের আগে স্থান দেবেন? আপনারা কি বিশ্বের দরবারে ভারতের মহান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতীয়মান করতে পারেন না? হ্যাঁ তা সম্ভব।
গত সাত দশক ধরে স্বাধীন ভারতের সেই সব মহান নেতাদের দূরদৃষ্টি ভারতকে একটি সন্তোষজনক স্থানে রাখতে পেরেছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের বহু গর্ব করার মতো অবদান আছে। কিন্ত সেই সাফল্য নিয়ে বসে থাকলে হবে না। আগামী দশকগুলি ভারতের ভবিষ্যৎ গড়ে দেবেন আজকের সাংসদ, বিধায়ক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তাঁদের কাঁধে আজ এক বিরাট দায়িত্ব।
সময় বেঁধে জাতীয় কার্যক্রম রচনা করে এবং তার প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের ভিতর এক বিশ্বাস তৈরি করতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। আমাদের সামনে আজ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ: অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে জোরদার করে বিশ্বময় যে আতঙ্কবাদ এবং যে নতুন ধরনের আইনশৃঙ্খলার সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তার মোকাবিলা; অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি হওয়া; পৃথিবীর জীবাশ্ম-জ্বালানির দ্রুত হারে হ্রাস পাওয়া; যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের পরিকল্পনা রচনা; একশো কোটি মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের জোগান, অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।
এই সব জাতীয় সমস্যাগুলির প্রতি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের, দলমত নির্বিশেষে, নজর দেওয়া প্রয়োজন। যে-কোনও গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হল সংসদ, তাই সাংসদদেরই এই সমস্যাগুলির সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তাঁদের এই মিশন রাষ্ট্রের এক ভিশনের জন্ম দেবে। তাঁদের উপরই নির্ভর করছে জনগণের এক সমৃদ্ধশালী, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ। সুতরাং সাংসদদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংসদের প্রত্যেক সদস্যের উচিত তাঁরা যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তার জন্য উঠে দাঁড়ানো। প্রত্যেক সাংসদের মধ্যে যেন যুবসমাজ এক মহান নেতা এবং তাঁদের রোল মডেল খুঁজে পান, এবং খুঁজে পান সেই নেতাকে যিনি রাজনীতি আর সমাজে নিয়ে আসবেন এক অত্যন্ত ক্রিয়াশীল পরিবর্তন।
এখানে আমি সরাসরি ভারতের সংসদের মাননীয় সদস্যদের উদ্দেশে বলতে চাই যে, আপনারা সঠিক নীতি ও আইন প্রণয়ন করে এবং সামাজিক রূপান্তরে সাহায্য করে একশো কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠাগুলিতে আপনাদের নাম উল্লেখ থাকার অপেক্ষায় আছে। ভারতকে এক উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে দিন, তার গরিমা হবে আপনার। বিশ্বকে আপনার পরিণত রাজনীতির পরিচয় দিন এবং দেখিয়ে দিন কীভাবে তাকে আপনি রাষ্ট্রের নিরন্তর উন্নয়নের কাজে লাগাবেন। এক অনুনাদশীল, সজাগ, নিরাপদ ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ার জন্য এগিয়ে আসুন। আমি নিশ্চিত এই ক্ষমতা আপনাদের আছে এবং তা সম্ভব হবে যদি আপনাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে।
উপসংহার
২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারির একটি ঘটনার কথা আমি এখানে বলতে চাই। মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে ‘সতপুরা শিক্ষণ প্রসারক মণ্ডল’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এই অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে আমি লাখ খানেক তরুণদের একটি সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলাম ‘আমি অনন্য’ এই বিষয়ে, সেখানে উপস্থিত ছিলেন বহু রাজনীতিক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ। ভাষণ শেষে অনেকগুলি প্রশ্নের মধ্যে এক তরুণ বালকের প্রশ্নটি ছিল তাত্পর্যের।
সে নিজেকে হারালী গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র বলে পরিচয় দিল। সে প্রশ্ন করল, ‘স্যার, আমাদের সংবাদমাধ্যমে এবং আমার বন্ধুরা সব সময়ে বলে যে, চিন ভারতের থেকে অনেক বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতি করেছে এবং তার অগ্রগতির হারও আমাদের থেকে বেশি। দয়া করে, স্যার, আপনি আমাদের বলুন কেন ভারত দ্রুত হারে অগ্রগতি করতে পারছে না। আপনি আমাদের বলুন, তার জন্য আমার মতো তরুণদের কী করতে হবে?’