.
তেরো : রাজনৈতিক নেতা
সব শেষে, মহান এক রাষ্ট্র গড়তে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে আমি বলতে চাই। একটি দেশের ভবিষ্যতের পরিবর্তন ঘটায় রাজনীতিকদের সিদ্ধান্ত, তাঁদের লক্ষ্য এবং তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম। এক অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া এক মহান রাষ্ট্র সম্ভব নয়। সুতরাং, আমাদের গভীর চিন্তার প্রয়োজন, কীভাবে এক মননশীল নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটানো যায়। এমন এক নেতৃত্ব যা হয়ে উঠবে নিজেই এক নিদর্শন আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের পথে এগিয়ে দিতে।
আমি এখানে স্মরণ করি আমার অভিজ্ঞতায় ভারতের ইতিহাসের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাকে।
শ্রেষ্ঠদের সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা
পি ভি নরসিংহ রাও ও অটল বিহারী বাজপেয়ী
১৯৯৬ সালের মে মাসের কোনও এক রাত্রি ৯টা বাজে তখন। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি থেকে আমাকে ফোনে বলা হল পি ভি নরসিংহ রাওর সঙ্গে সত্বর দেখা করতে। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার দু’দিন আগেই আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কালাম, আপনার দল নিয়ে আপনি এক আণবিক পরীক্ষার জন্য তৈরি থাকুন। আমি তিরুপতি যাচ্ছি। ওই পরীক্ষা আয়োজনের জন্য আমার অনুমতির অপেক্ষায় থাকবেন। ডিআরডিও-ডিএই (ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি)-এর দল যেন প্রস্তুত থাকে কর্মকাণ্ডটির জন্য।’ তাঁর মন্দির-শহরটিতে যাবার কারণ নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার জন্য প্রার্থনা।
যা ঘটল তা তাঁর আশার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। উড়িষ্যার চাঁদিপুরে মিসাইল রেঞ্জে আমি তখন ব্যস্ত। আমি ফোন পেলাম যে, বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়ে আমি যেন হবু প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে সত্বর দেখা করি। আমি অবাক হয়ে গেলাম এই দেখে যে, রাও চাইছেন আমি বাজপেয়ীকে আমাদের আণবিক যোজনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে দিই, যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি মসৃণভাবে হস্তান্তরিত হয়। এই ঘটনা দেখিয়ে দিল এক দেশভক্ত কূটনীতিকের পরিণত চিন্তাধারা এবং পেশাগত অসাধারণত্ব, যিনি মনে করতেন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে।
১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হয়ে প্রথম যে কাজটি বাজপেয়ী আমাকে দিয়েছিলেন, সেটি হল, যত শীঘ্র সম্ভব আণবিক পরীক্ষাটার ব্যবস্থা করা। কঠিন এবং কঠোর সিদ্ধান্ত উভয় নেতাই নিয়েছেন সাহসের সঙ্গে, হয়তো-বা সেই সিদ্ধান্তগুলির ফলাফল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হয়েছে অসীম গুরুত্বের।
ইন্দিরা গাঁধী ও বিজু পট্টনায়ক
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপিং প্রোজেক্ট-টির অনুমোদন দিয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে। হায়দ্রাবাদের ডিআরডিএল-এর অধিকর্তা ছিলাম আমি যখন সেই ১৯৮৪ সালে তিনি প্রকল্পটির পর্যালোচনা করতে সেখানে গিয়েছিলেন। শ্রীমতী গাঁধীকে আমরা যখন প্রকল্পটির অগ্রগতি সম্পর্কে জানাচ্ছিলাম, তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ওই অধিবেশন কক্ষে রাখা পৃথিবীর একটি মানচিত্রর উপর। তিনি আমাদের থামতে বলে বললেন, ‘কালাম, মানচিত্রটার দিকে তাকান। মানচিত্রে পূর্বদিকের দূরত্বটা দেখুন। আপনার ল্যাবরেটরি কবে একটি মিসাইল উৎক্ষেপণ করতে পারবে যেটি ওই জায়গাটিতে (যেটি ভারতীয় সীমারেখার ৫০০০ কিমি. দূরে অবস্থিত) গিয়ে পড়বে?’
এই ঘটনা আমাকে আর একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৯৩ সালে ডিআরডিও-তে আমরা পরীক্ষামূলক মিসাইল উৎক্ষেপণের একটি যথাযোগ্য স্থানের খোঁজ করছিলাম। পশ্চিম ভারতে মরু অঞ্চলে আমাদের স্থান নির্বাচনের প্রচেষ্টা সম্ভব হল না নিরাপদ রেঞ্জ আর ভৌগোলিক-রাজনৈতিক কারণে। সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা পূর্ব তটরেখায় কোনও জনমানবহীন দ্বীপের সন্ধানে ছিলাম। নৌসেনার তরফে আমাদের যে হাইড্রোগ্রাফিক মানচিত্র দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বঙ্গোপসাগরে কয়েকটি দ্বীপ নজরে এল। এগুলি উড়িষ্যার ধামরার তটরেখার বাইরে। আমাদের রেঞ্জ দলের দুই সদস্য ড. এস কে সালওয়ান ও ড. ভি কে সারস্বত একটি নৌকা ভাড়া নিয়ে দ্বীপগুলির খোঁজে গেলেন। মানচিত্রে দ্বীপগুলি লং হুইলার, কোকোনাট হুইলার এবং স্মল হুইলার নামে চিহ্নিত ছিল। একটি ডিরেকশনাল কম্পাস নিয়ে তাঁরা যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু তাঁরা পথ হারিয়ে ওই হুইলার দ্বীপগুলিকে খুঁজে পেলেন না। ভাগ্যবশত তাঁরা কয়েকটি মাছ ধরার নৌকার সাক্ষাৎ পেলেন, এবং তাঁদের কাছ থেকে সঠিক নির্দেশ চাইলেন। মত্স্যজীবীরা হুইলার দ্বীপের কথা জানেন না, তবে চন্দ্রচূড় নামের একটি দ্বীপের কথা জানালেন। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন হুইলারের কোনও একটা দ্বীপ হয়তো হবে। চন্দ্রচূড় দ্বীপের সম্ভাব্য অবস্থান জেনে নিয়ে তাঁরা সেই দিকে এগোতে থাকলেন। এইভাবে তাঁরা চন্দ্রচূড়ে গিয়ে পৌঁছলেন। পরে নিশ্চিত হল যে, সেটি স্মল হুইলার দ্বীপ। দ্বীপটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আমাদের কাজের প্রয়োজনে ছিল যথার্থ।
এরপরের ধাপে, এই দ্বীপটিতে কাজের জন্য উড়িষ্যা সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। রাজ্য সরকারের আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে এগিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়কের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আবশ্যক হয়ে পড়ল। তাঁর দপ্তর থেকে সংকেত পাচ্ছিলাম যে, আমাদের অনুরোধ নাকচ হয়ে যাবে কয়েকটি কারণে। যাই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটি মিটিংয়ের ব্যবস্থা হল।