ই-বিচারব্যবস্থা মামলাকারীদের পীড়া লাঘবের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। মামলা রুজু থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত সবকিছুই হবে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। এতে খুব সহজেই নথির সার্চিং, তার উদ্ধার, ঠিকভাবে সাজিয়ে নেওয়া, তথ্যের ও রেকর্ডের প্রক্রিয়াকরণ, এবং মামলার নিষ্পত্তিও হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে। স্বচ্ছতার শুরু হতে হবে ঘর থেকে। বিচারক, উকিল এবং অন্য সহযোগী স্টাফ ও মামলাকারী, সকলে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে হবে, এবং প্রত্যেককেই তাঁর কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
দেশের উন্নতির বিশাল দায়িত্ব রয়েছে আদালতের উপর। বিচারব্যবস্থাকে গতিশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা নিয়ে এই কর্মকাণ্ডে শামিল হতে হবে।
আইন ও নীতি
আইনকে আলাদা করে না দেখে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বিভিন্ন ভাবনাচিন্তার পরিবর্তনের সঙ্গে আইনের সম্পর্ক বুঝতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে বিগত দুশো বছরে। কিছু জিনিস যা বিজ্ঞান ভেবেছিল হওয়া সম্ভব, তা হয়নি; আর কিছু জিনিস যা ভাবা হয়েছিল অসম্ভব, তা সম্ভব হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখের হবে যদি আমাদের সমাজে যে বিবর্তন ও বিপ্লব ঘটে চলেছে তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের আইন ও নীতি অক্ষম হয়।
যে দ্রুততার সঙ্গে অগ্রগতি হচ্ছে এবং যার প্রভাব সমগ্র মানবজাতি এবং সমাজের উপর পড়ছে, তার জন্য আইন, বিজ্ঞান ও নীতির সংহতভাবে এক পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং আইনজ্ঞকে একসঙ্গে বসে একটি পথরেখা তৈরি করতে হবে যাতে প্রযুক্তির সাহায্যে আমাদের আইনব্যবস্থা, এক ভারসাম্য বজায় রাখা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
মানুষের জিনোম প্রকল্পের উদাহরণটাই দেখা যাক, যার সম্পর্কে এই বইয়ে আগে উল্লেখ করেছি। সেই প্রসঙ্গে যে প্রশ্নগুলি মনে আসে সেগুলি হল: প্রকল্পের যে ফলাফল তার মালিকানা কার? ব্যক্তির জিনগত তথ্য কে আহরণ করতে পারবে, এবং তা কেমনভাবে ব্যবহার করা হবে? জিনগত তথ্যের মালিক কে, কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে? কেমনভাবে জিনগত পরীক্ষার বিশ্লেষণ এবং প্রবিধান করে সঠিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং উপযোগিতা নিরূপণ হবে? আইনের অন্য যে দিকগুলির পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন তা হল অন্তরিক্ষ সংক্রান্ত আইন আর সাইবার আইন।
বিজ্ঞানের সাধনা প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে বুঝতে সাহায্য করে এবং তা মানব সমাজে বাস্তবোচিত প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়। তেমনই, সমাজকে শাসনে রাখতে যে আইন রচিত হয়েছিল তা আইনত কাজ করে সমাজে আনে শৃঙ্খলা এবং সুস্থিতি। কিন্তু যে সব ব্যক্তি এই আইনের প্রয়োগ করেন তাঁদের কোন আইনে নিয়ন্ত্রণ করা হয়? সেই আইন কে রচনা করেন? আমার মনে হয় এই সব বিস্তৃতভাবে চলে আসে ‘নীতি’র এক্তিয়ারে। এই নীতির অনুশীলন নিয়ম এবং বিধির থেকে অনেক বেশি জরুরি। সব শেষে, প্রয়োজন হয় সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের রূপান্তর।
উপসংহার
হাজারও বছর ধরে ভারত রাজারাজড়া দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। প্রত্যেক শাসকই এক গুচ্ছ আইন রেখে যান। তেমনভাবেই, ভারতে নানান ধর্ম মানা হয়ে এসেছে এবং তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ আইন আছে। ব্রিটিশরা দু’শো বছরের উপর আমাদের শাসন করে দিয়ে গিয়েছে আইনের শাসন, যার ভিত্তি তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আইনি অভিজ্ঞতা। অনেকগুলি দশক ধরে আমরা তা-ই মেনে চলেছি। প্রতিটি আইনই আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
বর্তমানে, ভারত এমন এক অভাবনীয়তার মধ্য দিয়ে চলেছে যেখানে তথ্য সমাজ, শিল্প সমাজ ও কৃষি সমাজকে প্রভাবিত করছে জ্ঞান সমাজ, উদ্ভাবন ও মূল্যবোধের সহযোগে। এই পরিস্থিতি ধন্যবাদার্হ, কারণ এর সাহায্যেই ২০২০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে ভারত। বহু দেশেই শুধুই অর্থনৈতিক অগ্রগতি সামাজিক জীবনে সুখ আনতে পারেনি। এর অর্থ, অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্যে স্থির থেকে, আমাদের সভ্যতার ঐতিহ্য থেকে নীতিজ্ঞান আর মূল্যবোধকে আহরণ করে আমাদের সমাজের বিবর্তনে তা প্রোথিত করে দিতে হবে। ভারতের উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে মিল রেখে আইনব্যবস্থার বিবর্তন হতে হবে। এর থেকেই জন্ম নেবে সুখী, সমৃদ্ধ এবং নিরাপদ ভারত।
আমি শেষ করব ভারতের উঠতি আইনজীবী এবং আইনব্যবস্থার পেশাদারিদের জন্য শপথ দিয়ে:
১। আমি আমার অভিজাত আইন পেশাকে ভালবাসি।
২। আমি সকল সময়ে আমার সব মামলায় সত্য উদ্ঘাটনের জন্য কাজ করব।
৩। প্রত্যেকের কাছে আইনব্যবস্থা পৌঁছে দেবার জন্য আমি সচেষ্ট থাকব, তাঁর অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা ব্যতিরেকে।
৪। আমি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করব যাতে আমার প্রতিটি মামলা সত্বর শেষ হয়।
৫। আমি আইনের সাহায্যে প্রত্যেক মানুষের জীবনের সম্মান রাখতে সচেষ্ট থাকব।
৬। আমি আইনের সাহায্য নিয়ে কখনওই কোনও নিরীহকে অপরাধী সাব্যস্ত করব না।
৭। আমি আইনের সাহায্যে রাষ্ট্রকে দুর্নীতি ও আতঙ্কবাদ মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকব।
৮। আমি কোনও সময়েই আইনকে এমনভাবে ব্যবহার হতে দেব না যাতে মানবকল্যাণ এবং জাতীয় উন্নয়ন বিঘ্নিত হয়।
৯। আমার রাষ্ট্রই আমার জীবন, আমি আমার আইনি জ্ঞানের সাহায্যে তার সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখব।