আমরা দেখি কেমনভাবে এক নিয়োজিত সিভিল সার্ভেন্ট ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়া সামাজিক এক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে কন্যাসন্তান সম্পর্কে ধারণার এক বিশাল পরিবর্তন এনে দিতে পারেন।
এম জি ভি কে ভানু
২০১১ সালের ২১ নভেম্বর, আমি আসামের জোরহাটে গিয়েছিলাম ওয়ার্ল্ড টি সায়েন্স কংগ্রেসে ভাষণ দিতে। জোরহাটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর সি জৈনের আয়োজিত প্রশাসক ও পুলিশ আধিকারিকদের একটি সভায় আমি বক্তৃতা দিই। ‘আমি সততার সঙ্গে কাজ করব এবং সফল হব সততার সঙ্গে’ নামে একটি শপথ অংশগ্রহণকারীদের দিয়ে পাঠ করিয়েছিলাম। ‘সততার সঙ্গে কাজ করব’ অংশটি সকলে উচ্চস্বরে বললেন, কিন্তু সে স্বর নীচে নেমে গেল ‘সফল হব সততার সঙ্গে’ অংশটির সময়ে।
পরের দিন অবশ্য, আমি এক অত্যন্ত সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখতে পেলাম ওয়ার্ল্ড টি সায়েন্স কংগ্রেসে মুখ্যমন্ত্রী ও জোরহাট প্রশাসনের উপস্থিতিতে। টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আই এ এস অফিসার এম জি ভি কে ভানুকে দেখলাম আমার সামনে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে সূচনা ভাষণ দিতে।
তিনি তাঁর ভাষণে বললেন, ‘গতকাল, ড. কালাম সকল আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের, যার মধ্যে আমিও অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, একটি শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই ড. কালাম, যে, আমি আমার আইএএস জীবনের চব্বিশ বছর রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সততার সঙ্গে কাজ করেছি এবং সফলও হয়েছি সততার সঙ্গে। আমি এখন টি বোর্ডে আছি। আমি আসামের মুখ্যমন্ত্রীর সচিব ছিলাম। আমি ড. কালামকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমি আমার সকল কাজে এক ধরনের নীতিনিষ্ঠ দৃঢ়তা বজায় রাখার চেষ্টা করে গিয়েছি।’
তিনি আরও বললেন যে, তিনি সারা রাত চিন্তা করেছেন কোন কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে ভারতকে সর্ববৃহৎ চা উৎপাদক ও রপ্তানির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে চান।
এই অনন্য অভিজ্ঞতাটি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমার খুব ভাল লাগল। যদি ভারত সরকারের প্রত্যেক কার্যনির্বাহক এমন ভিশন ও মিশন নিয়ে কাজ করেন, আমি নিশ্চিত ২০২০ সালের আগেই আমরা এক উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়ে উঠব।
উপসংহার
প্রায় ২২০০ বছর আগে তাঁর যোগসূত্র-তে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছিলেন: ‘তুমি যখন কোনও মহান উদ্দেশ্যে, কোনও অসাধারণ প্রকল্পের জন্য অনুপ্রাণিত, তখন তোমার চিন্তা সব সীমাই ছিন্ন করে দেয়। তোমার মন সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে, তোমার বিবেক সবদিকে বিস্তার করে এবং তুমি এক নতুন, মহান, অপূর্ব জগতে নিজেকে খুঁজে পাও। সুপ্ত শক্তি, মেধা এবং প্রজ্ঞা জাগ্রত হয়, এবং নিজেকে তোমার স্বপ্নের থেকেও এক বৃহত্তর ব্যক্তি হিসেবে তুমি আবিষ্কার কর।’ এই অনুপ্রাণিত কথাগুলি মনে রেখে সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য আমার পাঁচ-দফা শপথ দিয়ে শেষ করা যাক:
১। আমি যে জায়গায় কাজ করতে যাব, আমি সেখানকার মানুষকে ১০০ শতাংশ শিক্ষিত করে তুলতে কাজ করব, এবং আমি নিশ্চিত করব যাতে একটি শিশুও স্কুল ছেড়ে চলে না যায়।
২। আমি নিশ্চিত করব যাতে মহিলাদের অবস্থা সমৃদ্ধ হয়, এবং আমি ছেলে আর মেয়ের মধ্যে সাম্য আনতে কাজ করব।
৩। আমি নিশ্চিত করব যাতে কেউ আমাকে দুর্নীতির পথে প্রলোভিত না করতে পারে।
৪। আমি জেলায় যতদিন কাজ করব আমি নিশ্চিত করব যাতে এক লক্ষ গাছ রোপণ হয় এবং তাদের পরিচর্যা করা হয়।
৫। যে জেলায় আমার নিয়োগ হবে, সেখানে যাতে সেই জেলার অন্তত পাঁচটি ‘পুরা’ কমপ্লেক্স কাজ করতে পারে আমি নিশ্চিত করব, এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষের যাতে কাজের সুযোগ হয়, তার জন্য গ্রামীণ সংস্থা তৈরি করে কাজ করব।
.
বারো : বিচারব্যবস্থাপক
যে রাষ্ট্র ন্যায়ের পথে স্থিত সেই রাষ্ট্রই মহান এক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আশা করতে পারে। সমাজে ন্যায়, সাম্য ও ন্যায্যবোধের প্রতিষ্ঠা করে, এক মহান দেশের ভিত্তি স্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এক শক্তসমর্থ বিচারব্যবস্থা। সেই সঙ্গে, সময় মতো বিচার না হলে শুধু বিচারব্যবস্থা নয়, অস্বীকৃত হয় মহত্ত্বও। দুর্ভাগ্য এই যে, আদালতে মামলা পড়ে থাকা এবং নিষ্পত্তির জন্য অস্বাভাবিক দেরি হওয়া, এমন পরিস্থিতি ভারতের আইনব্যবস্থাকে পীড়িত করে রেখেছে বহুদিন ধরেই। ফলে, জাতীয় উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটে যাচ্ছে। আইন ও বিচার মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ভারতের উচ্চতম, উচ্চ, জেলা আর নিম্ন আদালতগুলিতে ৩ কোটি মামলা নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে। তার ১০ শতাংশ দশ বছরের বেশি সময়ের জন্য পড়ে আছে।
এর কারণ অনেক: আদালতের সংখ্যা অপ্রতুল এবং জুডিশিয়াল অফিসারদের সংখ্যাও অপর্যাপ্ত (একটি হিসেবে, ৭০,০০০ বিচারপতির স্বল্পতার দরুন ভারতের আইনব্যবস্থা ভুগছে); বিশেষ ধরনের মামলা সামলানোর ক্ষমতা জুডিশিয়াল অফিসারদের নেই; মামলাকারী এবং তাঁদের উকিলরা দীর্ঘসূত্রতার পদ্ধতি অবলম্বন করে, যেমন প্রায়শই মুলতুবি নেওয়া এবং সময়মতো কাগজ নথি জমা না দেওয়া; এবং সব শেষে আছেন আদালতগুলির প্রশাসনিক স্টাফরা।
শক্তসমর্থ বিচারব্যবস্থা
এই সব সমস্যার সমাধান করার প্রয়াস নিয়ে সত্বর বিচারের ব্যবস্থা করে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উচিত জাতীয় উন্নয়নের চালকের দায়িত্ব নেওয়া। জমে থাকা মামলাগুলির নিষ্পত্তি করা যেতে পারে মানবিক দৃষ্টি, সেগুলির বয়সের বিচার, বিতণ্ডার সমাধানে বিকল্প উপায়, ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত, ই-বিচারব্যবস্থা, বিচারক, উকিল এবং জুডিশিয়াল অফিসারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তাঁদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। আইনের নজরে যে সব মামলা এক ধরনের সেগুলি একত্রে একজন বিচারক বা বেঞ্চের কাছে পেশ করা যেতে পারে। যেমন, একই সরকারি দপ্তরের মামলাগুলি নিষ্পত্তির জন্য কোনও বিশেষ পদ্ধতির ব্যবস্থা। অহেতুক মুলতুবি না করে উকিলদের উচিত মামলা চালিয়ে যাওয়া। প্রতি মামলার নির্দিষ্ট সংখ্যার মুলতুবি বেঁধে দেওয়া থাকবে।