আমি ঠিক করলাম যে, কমিটি একটি উপস্থাপনা তৈরি করবে যেখানে সকল স্টেকহোল্ডার তাঁদের উত্তর পেয়ে যাবেন। কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করলাম কমিটির মিটিংগুলিতে অংশ নিতে, যেমন, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর অধ্যাপক এন বালাকৃষ্ণান, যিনি তদানীন্তন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন, কারণ রেল এক বৃহৎ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। মিটিংগুলি আমি আহ্বান করতাম কাজের সময়ের পর যাতে সকলেই উপস্থিত থাকতে পারেন।
নিরাপত্তা বিষয়েই বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারীর আপত্তি ছিল। বিশেষজ্ঞরা জানালেন নিরাপত্তার জন্য বিশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যপক্ষ বললেন, তা করতে গেলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রশ্ন এসে যাবে। উলটোদিকে যুক্তি দেওয়া হল যে, যাঁরা প্রকৃত ব্যবহারকারী তাঁদের ভয়ের কোনও কারণ নেই; শুধু যাঁরা কুকর্মে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন তাঁদেরই গোপনীয়তা নিয়ে সমস্যা হবে। এই নিয়ে বিতর্ক চলল বেশ কিছু সময় ধরে। অবশেষে, সকল অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ঐক্যমতে সিদ্ধান্ত হল যে, আইএসপি খুলে দেওয়া হবে বেসরকারি ক্ষেত্রেও।
আমি শ্রীপ্রভাত কুমারকে কমিটির পরামর্শ জানিয়ে দিলাম। তিনি তত্ক্ষণাৎ পরামর্শগুলিকে কার্যে পরিণত করতে ক্যাবিনেটের অনুমোদন নিয়ে নিলেন। সেই আইএসপি খুলে দেওয়ায় আজ ভারতে ১২০০ ক্রিয়াশীল সার্ভিস প্রোভাইডার রয়েছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী ১২ কোটি ১০ লক্ষ ইন্টারনেট ব্যবহাকারীকে তারা পরিষেবা দিচ্ছে। প্রতি বছর বৃদ্ধির হার ২০ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাই শুধু নন, এই সমগ্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের আইটি শিল্পরও উচিত শ্রীপ্রভাত কুমারের এই অবদানের জন্য তাঁকে স্মরণ করা।
সন্তোষ বাবু
২০০৯ সালে আমার আলাপ হয় ড. সন্তোষ বাবুর সঙ্গে। তিনি তখন ছিলেন ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন অফ তামিলনাডু (ইএলসিওটি)-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর তামিলনাডু ই-গভর্নেন্স এজেন্সি (টিএনইজিএ)-র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক। আমি গিয়েছিলাম হোসুর এফওএসটিইআরএ (ফস্টারিং টেকনোলজিস ইন রুরাল এরিয়াজ়)-এর ভার্চুয়াল বা কম্পিউটার যোগাযোগ কেন্দ্র এবং গ্রামীণ বাণিজ্য হাবের উদ্বোধনে। এটি একটি গ্রামীণ বিজ়নেস প্রোসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)। তিনি যখন কৃষ্ণগিরি জেলার কালেক্টার ছিলেন সেই সময়ে তিনি এই বিপিও-র চিন্তাধারাটির জন্ম দেন। তিনি আর তাঁর দল মিলে স্কুল-পালানোদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁর স্থাপিত বিপিও-তে নিয়োগ করতেন।
ড. বাবু জেলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, বিশেষ করে স্কুল-পালানোর সংখ্যা প্রায় শূন্যতে এনে ফেলায়। তিনি এটি সম্ভব করতে পেরেছিলেন প্রযুক্তি, জনগোষ্ঠীর সহযোগ এবং সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সাহায্যে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর সফটওয়্যারে মজুত ডাটার সম্ভার দেখে। তিনি প্রতিটি স্কুল-পালানো শিশুর খুঁটিনাটি ধরে রেখেছিলেন তাঁর সফটওয়্যারে যা সহজেই পাওয়া যায় www.back2school.in এই ঠিকানায়। তাঁর পদ্ধতিতে প্রতিটি শিশুর পরিবারের চাহিদা কী তার উল্লেখ থেকেছে, যার ফলে জেলা প্রশাসন তত্ক্ষণাৎ সাহায্য করতে পেরেছে।
একটি উদাহরণ। নির্মলা নামের একটি মেয়ে বারবার স্কুল পালিয়েছে। জেলা প্রশাসন তা রদ করার আন্তরিক চেষ্টা করেও কোনও ফল হয়নি। খুঁটিনাটি খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, তার পরিবারের প্রয়োজন একটি রেশন কার্ড, একটি বাসস্থান আর তার মায়ের জন্য একটি চাকরি। জেলা প্রশাসন রেশন কার্ড, ইন্দিরা আবাস যোজনায় একটি বাসগৃহ এবং তার মায়ের জন্য একটি সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দিল। কস্তুরবা গাঁধী বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে নির্মলাকে ভর্তি করে দেওয়া হল। কালেক্টার তার পরিবারের এই চাহিদাগুলি পূরণ করে দেবার পর নির্মলা নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করে দেয়।
যে জিনিসটি অনুধাবনযোগ্য তা হল, একটি শিশুর স্কুলে না যাওয়ার কারণটির খুঁটিনাটি অনুসন্ধান করেছেন ড. বাবু ও তাঁর দল। সমস্যাটিকে শনাক্ত করে তাকে নির্মূল করে বাচ্চাটির স্কুল যাওয়াকে মসৃণ করে দিয়েছেন। এইভাবেই, স্কুল-পালানোর হার কমে গিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি। এই দৃষ্টান্তটি দেখিয়ে দেয় কেমনভাবে একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার প্রযুক্তির সাহায্যে ও তাঁর নিজের কমিটমেন্ট ও প্যাশন দিয়ে কাজ করে সামাজিক জীবনযাপনে আনতে পারেন এক পরিবর্তন এবং এক সার্বিক সুখ।
স্বর্ণ সিংহ
ড. স্বর্ণ সিংহ পঞ্জাবের জলন্ধরের ডিভিশনাল কমিশনার ছিলেন ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অগাস্ট ২০০৭ পর্যন্ত। তিনি আর তাঁর স্ত্রী অমরজিৎ কৌর টেলিফিল্মের সাহায্যে রাজ্যের এক গম্ভীর সমস্যা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, সম্পর্কে সচেতন করার কাজ করেছেন। স্ত্রীর রচিত চিত্রনাট্য নিয়ে ড. সিংহ নির্মাণ করেছিলেন দু’ঘণ্টার ছবি Eh Tera Apmaan। চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়েছিল কেমনভাবে এক গ্রাম্য মহিলা নাতির মুখ দেখবে বলে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করে নিয়ে এল অপরাধ।
এর পাশাপাশি ড. সিংহ অন্য ধরনের বাস্তবোচিত ব্যবস্থা নিতেন, যেমন কোনও কন্যাসন্তানের জন্ম হলে তিনি সেই গোষ্ঠীতে উৎসবের আয়োজন করতেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক দিনে যতগুলি কন্যাসন্তান জন্মাল সবাইকার একই নামকরণ করে দিতেন জেলার কালেক্টার। আবার, যে পরিবারে বা ক্লিনিকে কন্যাভ্রূণ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, সেই বাড়ি বা ক্লিনিকের সামনে গোষ্ঠীর মানুষদের একত্র করে আয়োজন করা হত শোকসভা। কোনও স্লোগান নয়, শুধু শান্তিপূর্ণ শোকসভা সেই সব বেআইনি কাজ যাঁরা করেছেন তাঁদের লজ্জিত করে দিত। গোষ্ঠীর সকলের কাছে তা ছিল এক কড়া বার্তা।