আমরা এক অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বাস করছি। এই পরিবর্তন ঘটানোর পিছনে সর্বাগ্রে আছে প্রযুক্তির উন্নতি। এই উন্নতি এতটাই দ্রুতগতিতে হয়ে চলেছে যে, যারা তার সঙ্গে তাল মেলাতে অক্ষম, তারা পড়ে থাকছে কয়েক দশক নয়, কয়েক শতক পিছনে। আমাদের সমাজের পরিবর্তনের আর একটি কারণ প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে নগরায়ণ। আমাদের চতুর্দিকে মানুষের আকাঙ্ক্ষা আজ ঊর্ধ্বমুখী। তাঁরা সকলেই রয়েছেন কর্মসন্ধানে, কিন্তু কর্মসংস্থানের এই কঠিন সময়ে তাঁদের সকলের ভাগ্যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হয়তো নেই। আমাদের মতো দেশে সামাজিক বুনটকে ধরে রাখতে প্রাচীন সংস্কৃতি হয়তো একমাত্র উপায় নয়। আমাদের সকল দেশবাসী— ধনী বা গরিব, তরুণ বা বয়োজ্যেষ্ঠ, সুস্থ বা অসুস্থ— সকলের জন্য সম্মানীয়, নিশ্চিন্ত জীবন পাইয়ে দেওয়ার জন্য অতিক্রিয়াশীল হয়ে আমাদের সকলের একটা চেষ্টার প্রয়োজন।
বহু ক্ষেত্রেই ভারত বিরাট উন্নতি করেছে। তাকে অর্থনৈতিকভাবে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হতে আর শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু এই-ই কী সব? না, কখনও নয়। কারণ, জীবনযাপনের মান বাড়াতে এখনও অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে আমাদের। তাই এই বই যেন উন্নত মানবজীবনের এক ম্যানিফেস্টো, এক ঘোষণাপত্র। এখানে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি কোন কোন গুণে একটি দেশ মহান হয়ে ওঠে। জীবনযাপনের মানের ভিত্তিতে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করেছি। দেশে এবং দেশের বাইরে আমার বিভিন্ন ভ্রমণগুলি থেকে, আমার রীতি অনুযায়ী, আমি নিয়েছি বিভিন্ন সূত্র। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা মানুষজনের সঙ্গে আমার সংযোগ থেকেও নিয়েছি বহু সূত্র। এবং আমি এখানে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে দিয়েছি, কী করে প্রত্যেক সাধারণ ভারতীয়র জীবন এক সম্মানীয়, কার্যকরী, এবং সবার উপরে এক ঐশ্বরিক জীবনে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।
ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, সিভিল সার্ভেন্ট, আর চিকিৎসাশাস্ত্র সংক্রান্ত পেশাদারদের জন্য আমি কয়েকটি অনন্য শপথবাক্য রচনা করেছি, যাতে ওই উন্নততর মানবজীবন সকলের জন্য সম্ভব হয়। আমি সকল অভিভাবককে অনুরোধ করছি এই বইটি পাঠ করে, এর বার্তাটি আপন আপন সন্তানদের কাছে পৌঁছিয়ে দিন। শিক্ষকদেরও অনুরোধ করছি বইটি পড়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করতে। সাংসদদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন বইটি পড়ে সংসদে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তার কথা প্রচার করেন।
উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে নির্মিত হচ্ছিল। আমি আশা করি, যে-পাঠগুলি আমি চেষ্টা করেছি এখানে দিতে, সেগুলি আমাদের রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের ধাক্কাকে সামলে নিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে মহানত্বের পথের দিশা দেখাবে।
এ পি জে আবদুল কালাম
মার্চ ২০১৫
১. টুকরো মন্তব্য
পর্ব ১ : টুকরো মন্তব্য
এক
একটি রাষ্ট্র কোন গুণে মহান?
একটি রাষ্ট্র কীসে বা কোন গুণে মহান হয়, সেই আলোচনায় যাবার আগে আমি মানব বিবর্তনের গবেষণায় যে অগ্রগতি হয়েছে, তার কথা কিছু বলতে চাই। এই বিষয়টি বুঝতে চিরাচরিতভাবে দু’টি পথে এগোনো হয়। প্রথমটি হল পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে। মহেঞ্জো-দারো আর হরপ্পা বা পৃথিবীর অন্যত্র ওই ধরনের অন্যান্য খনন প্রক্রিয়ায় উঠে আসা প্রমাণগুলি এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বহু ধরনের সভ্যতার যাপনচিত্র, তাদের সংস্কৃতি এবং ব্যুত্পত্তির হদিশ দিয়েছে তারা।
দ্বিতীয় এবং সাম্প্রতিকতম পথটি চালিত হয়েছে মানব জিনোম বিষয়ে আমাদের উন্নততর জ্ঞানের সাহায্যে। মানুষের জিনের ক্রমের বৃহদাংশ সকল মানুষেই এক, স্বল্পাংশে শুধু দেখা যায় পার্থক্য। এই পার্থক্যর ফলেই মানুষের মধ্যে আমরা দেখতে পাই এত বৈচিত্র্য। দক্ষিণ আফ্রিকার অধ্যাপক ফিলিপ টোবিয়াস (১৯২৫-২০১২) ছিলেন জিনতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের এক পুরোধা পুরুষ, যিনি আমাদের এই কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসকে জানতে সাহায্য করেছেন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের গবেষণার নতুন পথ দেখিয়েছে তাঁর কর্মকাণ্ড।
২০০৫ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি (এনজিএস), ইন্টারন্যাশনাল বিজ়নেস মেশিনস (আইবিএম) এবং ওয়েট ফাউনডেশন (একটি মার্কিন সংস্থা যারা সমুদ্রের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধারের কাজে নিযুক্ত), সম্মিলিতভাবে ‘জিনিয়োগ্রাফিক প্রোজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে। এর লক্ষ্য, জিনগত নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়নের জন্য সারা বিশ্বের কয়েক লক্ষ মানুষের ডিএনএ-র নমুনা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে ইতিহাসে যত মানব অভিবাসন হয়েছে, তার একটি মানচিত্র নির্মাণ করা। মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর এম পিচাপ্পান এই প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে আমার আলোচনা আমার কাছে ছিল এক চিন্তা-উদ্রেককারী অভিজ্ঞতা।
ভবিষ্যতে কোনও একদিন হয়তো, ‘একটি রাষ্ট্র কোন গুণে মহান?’-এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ওই মানব জিনে-ই। আপাতত এইটুকু বলা যায় যে, দেশের জনসাধারণ রাষ্ট্রর থেকে মহান। তাঁদের মননশীল নেতৃত্ব, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অংশীদারির গৌরব, এবং তাঁদের দূরদৃষ্টি— এই সবকিছু মিলিয়ে তাঁরা তাঁদের রাষ্ট্রকে করে তোলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।