ভারতের রাষ্ট্রপতি হবার আগে, স্যাটেলাইট লঞ্চিং ভেহিকল (এসএলভি) প্রকল্প এবং পরে ওই ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের নির্মাণ ও কার্যক্ষম করার সময়ে, আমি বেশ কিছু বরিষ্ঠ সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে চিন্তার আদানপ্রদান করেছিলাম। পরবর্তীকালে, আমি শ’য়ে শ’য়ে সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি, যখন আমি মুসৌরির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এ সিভিল সার্ভিস প্রোবেশনারদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছি। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন, রাষ্ট্রপতি ভবনে নতুন সিভিল সার্ভেন্টরা আমার সঙ্গে এসে দেখা করতেন। আমি তাঁদের পাঁচ-দফা শপথ (যার বিষয়ে আমি এই অধ্যায়ের শেষে আসব) পাঠ করাতাম। আমি ভারতের গ্রাম অঞ্চলে গেলে কোনও কোনও পরিচিত সিভিল সার্ভিস অফিসার মুসৌরি বা রাষ্ট্রপতি ভবনে আমার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বর্তমানে তাঁদের কর্মকাণ্ডের কথা বলতেন।
২০০৫-এ সংসদের উভয় কক্ষের উদ্দেশে আমার বক্তৃতায় সাংসদদের সঙ্গে যে কবিতাটি আমি ভাগ করে নিয়েছিলাম সেটি আমি এখানে বলতে চাই:
প্রিয় বন্ধু, আমরা এখন কোথায়?
সেই মহাসভায় যেখানে আমাদের ইতিহাস গড়া হয়।
ভারতের জনতার হৃদস্পন্দনের ডাক।
জনতা প্রশ্ন করে, জনতা প্রশ্ন করে:
হে! সাংসদরা, ভারত মাতার ভাস্কর,
আলোয় নিয়ে চল আমাদের, আমাদের জীবন সমৃদ্ধ কর।
তোমাদের সততার শ্রম, আমাদের আলোর দিশারী,
তোমরা যদি কঠোর শ্রম দাও, আমরা সমৃদ্ধ হব।
যেমন রাজা, তেমন জনতা,
মহান চিন্তার লালন কর, উঠে দাঁড়িয়ে কাজে লাগ,
সততার পাথেয় হোক তোমাদের দিশারী।
ঈশ্বরের কৃপায় তোমাদের শ্রীবৃদ্ধি হোক।
আমাদের রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যতটা সাংসদদের হাতে, ততটাই তা আমাদের সিভিল সার্ভেন্টদের হাতে। আমি ভারতের সিভিল সার্ভেন্টদের জোর দিয়ে বলব তাঁরা যেন এই কবিতাটার মর্ম উপলব্ধি করে তা অন্তরে গ্রহণ করেন— তোমরা যদি কঠোর শ্রম দাও, আমরা সমৃদ্ধ হব।
মুসৌরিতে সংযোগ
২০১০ সালে আমি মুসৌরি গিয়েছিলাম। সেখানে পঁচাশিতম ফাউন্ডেশন ব্যাচ-এ সদ্য-যোগ দেওয়া সিভিল সার্ভিস অফিসারদের সঙ্গে সংযোগ ঘটেছিল। প্রশিক্ষণের মধ্যবর্তী পর্যায়ের ট্রেনিদের উদ্দেশে আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। আমি তাঁদের মননশীল ও উদ্ভাবনী নেতৃত্ব এবং আরও ভাল এক পৃথিবীর উন্মেষের কথা বলেছিলাম। বক্তৃতা শেষে অংশগ্রহণকারীদের থেকে কিছু অনন্য প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেগুলি ছিল আমলাতন্ত্রের উচ্চতম পর্যায়ে প্রশাসনকে যে সুযোগ আর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তার উপর। আমি এই তরুণ অফিসারদের বলেছিলাম যে, কেমনভাবে তাঁরা মননশীল নেতৃত্ব দিয়ে জীবনের মহান সব কর্মযজ্ঞে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন, তার উপায় চিন্তা করুন। বক্তৃতার পর এক তরুণী অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ড. কালাম, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য আমলাতন্ত্র খ্যাত এবং সেই ভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। ফলে তার প্রেক্ষিতে আমি কীভাবে মননশীল ও উদ্ভাবনী হতে পারব?’ আর এক তরুণ অফিসার বললেন, ‘স্যার, এই মুহূর্তে, যখন আমরা আমাদের কর্মজীবনের শুরুতে রয়েছি, আমাদের ন্যায়বোধ প্রখর এবং সততায় আমরা দৃঢ়। আমরা সকলেই কঠোর পরিশ্রম করে পরিবর্তন আনতে চাই। কিন্তু এক দশক পর, আমাদের পারিপার্শ্বিক সত্ত্বেও আমরা কেমনভাবে ওই একই ন্যায়বোধ নিয়ে সমান উচ্ছ্বাসে কাজ করে যেতে পারব?’
এই প্রশ্নগুলির উত্তরে আমি বললাম যে, যে তরুণ অফিসাররা প্রশাসনে ঢুকছেন তাঁদের এক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য স্থির করে নিতে হবে, যাতে তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন। ওই লক্ষ্য তাঁদের সকল সময়ে উদ্বুদ্ধ করবে এবং সকল বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করবে। আমি তাঁদের বললাম যে, আমাদের রাষ্ট্রের তরুণ অফিসারদের মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা যখন কোনও কঠিন কর্মযজ্ঞে ঢুকবেন, তখন নানা সমস্যা আসবে। কিন্তু এই সমস্যাগুলি যেন আমাদের অধিনায়ক হয়ে না দাঁড়ায়; সমস্যাগুলিকে পরাস্ত করে আমাদের সাফল্য পেতে হবে।
আর এক তরুণ অফিসার বললেন, ‘ড. কালাম, আপনি বললেন যে, আমাদের কাজ করতে হবে সত্যনিষ্ঠা নিয়ে এবং সাফল্যও পেতে হবে সততার সঙ্গে। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং আমাদের বরিষ্ঠরা যাঁরা দুর্নীতিপরায়ণ তাঁরা তো কোনও এক সময়ে আমাদের ন্যায়-নীতিবোধের সঙ্গে আপোস করতে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করবেন। আমরা কীভাবে তার মোকাবিলা করব?’ এই প্রশ্নটি সম্পর্কে আমি চিন্তা করলাম। প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবসম্মত। প্রত্যুত্তরে আমি, আমার রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বললাম।
আমি ডিআরডিও-র সচিব, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং ভারত সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ছিলাম। এই প্রতিটি পদেই আমার দায়িত্বে ছিল বিরাট বিরাট কর্মযজ্ঞ যার মূলধনী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল বিশাল। কিন্তু কোনও সময়েই কোনও নেতা বা কোনও প্রশাসক আমার কাছে কোনও সুবিধে পাওয়ার আশায় আসেননি। আমি তরুণ অফিসারদের বললাম যে, তাঁরা তাঁদের নিজেদের এক ধরনের সততা তৈরি করে নিন যাতে যাঁরা নীতির সঙ্গে আপোসের কথা বলতে চান তাঁরা দূরেই থাকবেন। অবশ্যই, এরও কিছু সমস্যা থাকবে। কিন্তু অবশেষে, মানুষের মধ্যে যা শুভ তা সফল হবেই।