৮। নেতার কাজে এবং সাফল্যে থাকবে সততা।
একুশ শতকের জন্য ভারতের হাসপাতালগুলিকে প্রস্তুত করে একশো কোটির বেশি জনগণকে উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার জন্য মননশীল নেতৃত্বের প্রয়োজন এই বৈশিষ্ট্যগুলি আয়ত্ত করা।
ছ’টি গুণ যা স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের থাকা আবশ্যিক
২০০৮ সালের নভেম্বরে কাঠমান্ডু ইউনিভার্সিটির চতুর্দশ সমাবর্তন ভাষণ দিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে বৌদ্ধনাথে কা-নিইং শেদ্রুব লিং বৌদ্ধ মঠে গিয়েছিলাম এবং সেখানকার প্রধান সন্ন্যাসী চোকিই নিইমা রিনপোচের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকও বটে। অভ্যর্থনার পর তিনি আমাকে তাঁর অধ্যয়ন কক্ষে নিয়ে গেলেন। এক তরুণের মতো তিনি দৌড়ে উঠে গেলেন ওই পাঁচতলা। আমি তাঁর পিছন পিছন কষ্টসাধ্য ধীর পায়ে উঠলাম।
তাঁর ঘরটি থেকে হিমালয় দৃশ্যমান। ঘরটিতে এক আধ্যাত্মিক বাতাবরণ উপস্থিত। আমাকে যা বিস্মিত করল তা হল যে, তাঁর গবেষক ছাত্ররা সব এসেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তাঁর সহ লেখক, ডেভিড আর শ্লিম, এমডি-র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যৌথভাবে তাঁরা একটি বই লিখেছেন, Medicine and Compassion: A Tibetan Lama’s Guidance for Caregivers নামে। বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় হল, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের বৃদ্ধ, অসুস্থ বা অপারগ স্নেহের জনের বিধি বহির্ভূত সেবক হিসেবে কাজ করি। পেশাগত সেবক-সেবিকা নিয়োগ করলেও সেভাবে যত্ন দেওয়া যায় না।
Medicine and Compassion পাঠকের সঙ্গে সেবা দানের সত্যিকারের আদর্শের যোগ ঘটায়। বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা থেকে সেবার আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করে বাস্তবে তার প্রয়োগের কথা বলে এই বই। যাঁরা তাঁদের চিকিৎসা বা তাঁদের সেবকদের বিষয়ে অসন্তুষ্ট বা যে ব্যক্তি মৃত্যুর পথে অথবা যাঁদের অবস্থা সংকটজনক তাঁদের পরিবারের জন্য বাস্তবোচিত পরামর্শ রয়েছে এই বইতে। যাঁরা তাঁদের সহনশীলতা, সহমর্মিতা আর কার্যকারিতাকে নতুন উদ্যমে ফিরে পেতে চান তাঁদের জন্য এই বই এক প্রেরণা।
চোকিই আর আমার মধ্যে কিছু বইয়ের আদানপ্রদান হল। তিনি আমাকে যে বইগুলি দিলেন তার অন্যতম ছিল Medicine and Compassion। কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি আসার পথে বইটি আমি পড়লাম। আমার অসম্ভব ভাল লাগল। মূল যে বিষয়টি আমি বইটি থেকে আহরণ করলাম তা হল, ছ’টি গুণ প্রত্যেক চিকিৎসাশাস্ত্রের পেশার ব্যক্তির থাকা আবশ্যক। রিনপোচে আর শ্লিমের মতে, এই ছ’টি গুণ হল, উদারতা, বিশুদ্ধ ন্যায়বোধ, সহনশীলতা, অধ্যবসায়, সম্পূর্ণ মনঃসংযোগ এবং মেধা। সেবকের মধ্যে এই গুণগুলি থাকলে তবেই মুমূর্ষুর যত্ন নিতে পারবেন সেবক। সারা পৃথিবীর চিকিৎসাশাস্ত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিরা, স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী, নার্স এবং প্যারামেডিকাল স্টাফদের জন্য এ যেন এক পথ নির্দেশিকা।
বিশ্বাসের শক্তি
আর একটি বই যা আমার অত্যন্ত প্রেরণাকারী মনে হয়েছে তা হল, The Biology of Belief: Unleashing the Power of Consciousness, Matter and Miracles. বইটির লেখক আমার বন্ধু ড. ব্রুস লিপটন আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বইটি নব্য জীববিজ্ঞানের এক নতুন রাস্তা খুলে দিয়ে আমাদের চিন্তা সম্পর্কের ধারণায় বিপ্লব এনে দিয়েছে। মনের এবং শরীরের পারস্পরিক ক্রিয়া এবং কোশ কেমনভাবে তথ্য গ্রহণ করে, এই বিষয়ে ড. লিপটন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা অবিশ্বাস্য নতুন আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, জিন এবং ডিএনএ আমাদের জৈবিক কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে না। পরিবর্তে ডিএনএ নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু কোশবহিঃস্থ বার্তা দ্বারা। এই বার্তার মধ্যে আমাদের চিন্তাভাবনাও অন্তর্ভুক্ত। সহজ করে বললে, জিন এবং ডিএনএ-কে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের বিশ্বাস, আমাদের প্রত্যয়।
এই বক্তব্যকেই তিনি প্রসারিত করে যুক্তি দিচ্ছেন যে, রোগ আর তার চিকিৎসার ভিত রয়েছে আমাদের চিন্তায় যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে কোশের। তিনি বলছেন, ‘এই বিশ্বাসের শক্তিকে ডাক্তাররা যেন ওষুধের রাসায়নিক বা অস্ত্রোপচারের ছুরির থেকে নিকৃষ্ট মনে না করেন।’
মহাত্মা গাঁধীও বলেছেন যে, আমাদের নিয়তিকে গড়ে তোলে আমাদের চিন্তা। ড. লিপটন তাঁকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন:
Your beliefs become your thoughts
Your thoughts become your words
Your words become your actions
Your actions become your habits
Your habits become your values
Your values become your destiny.
আমি সকল স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীকে বলব, তাঁরা যেন ড. লিপটনের বইটা পড়ে তার বার্তাটি উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে তাঁদের রুগিদের সেই প্রশিক্ষণ দেন যাতে রোগ থেকে নিরাময় হয়ে উঠতে তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসের শক্তিকে প্রয়োগ করতে পারেন।
মানুষ তাই-ই হয়ে ওঠেন যা তিনি চিন্তা করেন
এই প্রেক্ষিতে আমি আর একটি বইয়ের কথা বলব যেটি পড়ে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। বইটি হল মরিস গুডম্যানের লেখা The Miracle Man: An Inspiring True Story of the Human Spirit। তাঁর ছত্রিশ বছর বয়সে, ১৯৮১-র মার্চে, মরিস গুডম্যান যখন একটি প্লেন চালাচ্ছেন, তখন তাঁর ইঞ্জিনটি বিনা হুঁশিয়ারিতে হঠাৎই বন্ধ হয়ে যায়। রানওয়েতে কোনওভাবে প্লেনটাকে নামিয়ে আনতে চেষ্টা করলেও কিছু বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে উলটে গিয়ে সেটি মাটিতে আছড়ে পড়ে। দুর্ঘটনায় তিনি পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর শিরদাঁড়া চূর্ণ হয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় কশেরুকা দু’টি ভেঙে যায়। সাহায্য ছাড়া তিনি খাওয়াদাওয়া এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসও চালাতে পারতেন না। শুধু চোখের পাতা খোলা-বন্ধ করতে পারতেন। ডাক্তাররা বলে দিলেন, সারা জীবন তাঁকে অসাড়ত্ব নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।