তিনি তাত্ক্ষণিক কোনও উত্তর দিলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি হেসে বললেন, ‘আপনি ভারতের রাষ্ট্রপতি। আমাদের এবং সারা দেশের সব কিছু সম্পর্কে আপনার জানা উচিত।’
আমি বললাম, ‘আপনি দয়া করে আপনার সুচিন্তিত বিশ্লেষণ আমাকে জানান। আমার খুব প্রয়োজন এটা জানার।’
আমাদের ঠিক পিছনেই বুদ্ধর হাস্যোজ্জ্বল প্রদীপ্ত স্বর্ণাভ মূর্তি। প্রধান ভিক্ষু প্রায় একশো যুব এবং প্রবীণ অভিজ্ঞ ভিক্ষুদের সেখানে জড়ো করলেন। তিনি এবং আমি তাঁদের মাঝে বসলাম। তিনি তাঁদের একটি ছোট বক্তৃতা দিলেন, যা আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
‘বর্তমান পৃথিবীতে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ হিংসাতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই মনাস্ট্রি এই বার্তাই প্রচার করে যে, যখনই তুমি “আমি”-কে তোমার মন থেকে সরিয়ে দিতে পারবে তখনই তোমার অহং-ও বিলুপ্ত হবে। তুমি যে মুহূর্তে তোমার আমিত্ব ত্যাগ করতে পারবে, তখনই অন্যের প্রতি তোমার ঘৃণা দূর হবে। যে মুহূর্তে ঘৃণা তোমার মন থেকে দূর হবে সেই ক্ষণেই হিংস্রতা অদৃশ্য হয়ে যাবে। হিংস্রতা দূর হলেই সেই জায়গায় শান্তি প্রস্ফুটিত হবে। এবং তখনই সমাজে শান্তি আর শুধু শান্তিই ফুটে উঠবে।’
এইভাবেই আমি জানতে পারলাম প্রশান্তিময় জীবনের সুন্দর সূত্রটি। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন কাজটি হল ‘আমি’-কে চিন্তার জগৎ থেকে সরিয়ে ফেলা। তাই আমাদের প্রাচীন দার্শনিক জ্ঞানীদের শিক্ষা আমাদের সন্তানদের মধ্যে প্রোথিত করতে হবে তাদের কম বয়স থেকেই।
৩। ক্ষমাশীলতা
আমার প্রশ্ন, ‘কীভাবে একটি প্রশান্তিময় সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ে ওঠে?’, তার উত্তরের একটি অংশ পেয়েছিলাম তাওয়াং-এ। কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যের অন্বেষণ আমার জারি ছিল। ওই বছরই তারপর বুলগেরিয়া ভ্রমণে গেলাম আমি।
দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের শেষে আমি সেখানকার বিখ্যাত রিলা মনাস্ট্রিতে গেলাম। দশম শতাব্দীতে বুলগেরীয় সন্ন্যাসী সন্ত ইভান রিল্স্কির ভক্তরা মিলে নির্মাণ করেছিলেন এই মনাস্ট্রি। ওই দেশের এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাবার পর ঊনবিংশ শতকে এটি সম্পূর্ণভাবে পুনর্নির্মিত করা হয়। বুলগেরীয়দের কাছে পবিত্র এই স্থানের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে আমার কৌতূহল ছিল। আমি সেখানকার যাজকদের সঙ্গে তাওয়াং-এর বার্তাটি বিষয়ে আলোচনা করলাম। তাঁরা আমার প্রশ্নের উত্তরের অন্য অংশটি জানালেন।
তাঁদের মূল বার্তাটি হল, ক্ষমাশীলতা, যা এক পবিত্র জীবনের ভিত্তি তৈরি করে।
৪। দানধ্যান এনে দেয় শান্তি ও সুখ
২০০৪ সালে তেমনই এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দর জন্মভিটায়। উত্তর কলকাতার ৩ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে তাঁর পৈতৃক বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করে জনসাধারণের জন্য ওই বছর অক্টোবরে খুলে দেওয়া হয় প্রচুর আনন্দোত্সাহের সঙ্গে। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় উদ্বোধনের জন্য।
১৮৬৩ সালে ওই বাড়িতে স্বামীজি জন্মগ্রহণ করেন। ওই সময়ে বাড়িটির চার ধারে বাগান আর তার ওপারে ছিল একটি উন্মুক্ত স্থান। পরবর্তীকালে শহরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটিতে যাওয়ার রাস্তাটি সরু হতে শুরু করে এবং তা একটি গলিপথে পরিণত হয়। অষ্টাদশ শতকের বাড়িটির ভগ্নদশা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রামকৃষ্ণ মিশন সেটিকে অধিগ্রহণ করে পুনর্নির্মাণ করে একটি স্মারক সংগ্রহশালাতে পরিণত করে।
তার সঙ্গে পাশের জমিতে তৈরি হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক ও গবেষণা কেন্দ্র এবং একটি পাঠ্যবইয়ের গ্রন্থাগার।
উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে স্বামীজির শিষ্যদের আমি আমার তাওয়াং অভিজ্ঞতার কথা বললাম। তাঁরাও মনে করেন এটি একটি অপূর্ব বার্তা। এর সঙ্গে তাঁরা যোগ করলেন, কাউকে কোনও দান অর্পণ করলে বৃদ্ধি পায় সুখ শান্তি।
৫। ভাল কাজ এনে দেয় শুভ ক্রিয়া
একবার রাজস্থানের অজমেরে খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির বিখ্যাত দরগায় আমি গিয়েছিলাম। শুক্রবারের নামাজ পাঠের পর আমি এক সুফি জ্ঞানীজনের সঙ্গে আলোচনায় বসি। তিনি আমায় বলেন যে, সর্বশক্তিমানের সৃষ্ট এই মানুষ আজ এক শক্তিমান শয়তানের সম্মুখীন। সে মানুষকে মন্দ কাজে প্রলুব্ধ করছে। একমাত্র ভাল কাজই পারে ভাল চিন্তার জন্ম দিতে, এবং শুভ চিন্তাই সেই ক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে যা থেকে, সর্বশক্তিমানের নির্দেশে, বিচ্ছুরিত হয় প্রেম।
আমি যখন দশ বছরের বালক আমি প্রায়ই দেখতাম যে, আমাদের বাড়িতে তিনজন মানুষের আলোচনা হত। এঁরা হলেন পক্ষী লক্ষ্মণ শাস্ত্রীগাল [Pakshi Lakshmana Sastrigal], বিখ্যাত রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত এবং একজন বৈদিক পণ্ডিত; রেভারেন্ড ফাদার বোদেল [Bodel], যিনি রামেশ্বরম দ্বীপের প্রথম চার্চটির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; এবং আমার পিতা যিনি ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। এঁরা নিজেদের মধ্যে বসে দ্বীপটির সমস্যাগুলি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করতেন এবং সমাধান সূত্র বের করে দিতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নিজেদের সহমর্মিতা দিয়ে সেতু রচনা করতেন।
যুবসমাজ কী ধরনের বিশ্ব নির্মাণে এগোবে— এই কথা চিন্তা করলেই ওই স্মৃতি আমার মনে আসে। মনের মিলন ও সম্প্রীতি হল ভারতের হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি। আমি এই কথাই বলব যে, আমাদের যুবশক্তিকে বোঝাতে হবে যে, সমাজে বিচ্ছিন্নতাবাদকে অতিক্রম করতে হবে তাদের। সারা বিশ্বের ও আমাদের দেশের অগণিত সমস্যার বহু ক্ষেত্রেই সমাধান পাওয়া যাবে যদি এই পথে তারা এগোয়।