একটি রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও সুখের একটি বিশিষ্ট সূত্র হল তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করে এই সমৃদ্ধি। তবে, ব্যক্তির মতোই রাষ্ট্রকেও যেতে হয় কঠিন সময়ের ভিতর দিয়ে। সেই কঠিন সময়ে কী ঘটতে থাকে এবং রাষ্ট্র কীভাবে তার মোকাবিলা করে, তাও উন্নয়নের একটি উত্তম মাপকাঠি। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তির উপর গুরুত্ব দিলেই কি আমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব? সত্যিকারের নিরন্তর ধরে রাখা উন্নতির পথ হবে সেইটি, যেটিতে রাষ্ট্র তার শৃঙ্খলাপরায়ণতা বজায় রেখেও কঠিন সময়কে উত্তীর্ণ করে যাবে। সেখানে ব্যক্তি, সাধারণ মানুষের জন্য শুভ চিন্তা করবেন আর তাঁর সহ-দেশবাসীকে দেবেন তাঁদের প্রাপ্য সম্মান।
বই প্রকাশের এই প্রকল্পের কাজটি অগ্রসর হতে থাকে, আর সময় সময়ে এই সব বিষয়ে আলোচনা চলতে থাকে। একটি সংশোধিত খসড়া জমা দিয়ে তিনি জানালেন, তাঁর কাজ তিনি করে দিয়েছেন। ২০১৫ সালের ১১ জুলাই আমাদের শেষ সাক্ষাত্কারে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, বইটি মেজর জেনারাল আর স্বামীনাথনকে, যিনি ২০১৩-তে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন বহু বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা সহায়তাকারী, উৎসর্গ করা হবে। আমি সেইদিন যখন বেরিয়ে আসছি, ড. কালাম বললেন, ‘তা হলে আমরা এইটি করবই।’ ২৭ জুলাই আমি যখন তাঁর শিলং থেকে ফেরার পর একটা সাক্ষাত্কার চেয়ে যোগাযোগ করলাম, শ্রীশর্মা, যিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট-এ বক্তৃতার জন্য তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন, আমাকে জানালেন যে, তিনি অসুস্থ। সেই সন্ধ্যায় টিভিতে দুঃখজনক সংবাদটি সম্প্রচারিত হল।
অন্য অনেকগুলি বই তাঁর প্রকাশিত হয়েছে যখন উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে নির্মিত হচ্ছিল। সংশোধিত পাণ্ডুলিপিটি আমাকে দেওয়ার কয়েক মাস পর তিনি সৃজন পাল সিংহ-র সহযোগে লেখা আর-একটি পাণ্ডুলিপি, Advantage India, দেন, যা অক্টোবর ২০১৫-তে প্রকাশিত হয়। উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে তার পূর্বেই লেখা কিন্তু প্রকাশিত হতে সময় লেগে যায়। কারণ, তাঁর সঙ্গে বসে বইটির রিভিউয়ের কাজ চলছিল যখন তিনি মারা যান। এই বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছে। আমাদের বিচারে বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে— ছাত্র থেকে গৃহী থেকে নেতা, যাঁরা বইটি থেকে গ্রহণ করতে পারবেন অনেক কিছু এবং দিতেও পারবেন— তাঁদের ভেতরে এই বইয়ের প্রচার ব্যাপক আকারে হওয়া বাঞ্ছনীয়। ড. কালামের একটি প্রিয় উক্তি ছিল: ক্ষুদ্র লক্ষ্য একটি অপরাধ। উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে-তে এই কথাই তিনি জোরের সঙ্গে আবারও বলেছেন এবং আমাদের জন্য মানাঙ্কটি বাড়িয়ে এ বইয়ের একটি মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে গিয়েছেন যা বলা যেতে পারে চিরন্তন। এই বই যে ভিন্নতা এনে দেয় তা দেখে তিনি অফুরান আনন্দ পেতেন অবশ্যই।
সম্পাদক
ফেব্রুয়ারি ২০১৭
.
প্রাক্কথন
বন্ধুগণ, যে বইটি আজ আপনারা ধরে আছেন আপনাদের হাতে, সেটি আমার এককভাবে বা কোনও সহলেখকের সঙ্গে লেখা পঁয়ত্রিশতম বই। আমার লেখা এর মধ্যে অনেকগুলি বই-ই বেস্ট-সেলার তালিকায় এসেছে। তাদের মধ্যে দু’টি, Ignited Minds আর Wings of Fire, দশ লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু, আমি প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করি, এই বইগুলির মাধ্যমে আমি কোন বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে চাইছি। আমাদের রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে কী করে উন্নতি করবে, অথবা ভারতের তরুণ সমাজের সামনে তাদের আদর্শ পথ কোনটি, বা আমাদের দেশের জীবনালেখ্যের কিছু ঘটনা, এই সব নিয়েই আমি এতদিন লিখেছি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে আমি যেন কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ রেখে গিয়েছি।
এই উত্তরণ: শ্রেষ্ঠত্বের পথে সকলে-র পিছনের ভাবনাটি হল, শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতি একটি দেশকে সর্বোত্তম করে তুলতে পারে না। সবার আগে প্রয়োজন একটি জাতীয় চরিত্রের নির্মাণ, যা জন্ম নিতে পারে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ, স্কুলের শিক্ষা, আর দেশের সংস্কৃতি থেকে। একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলি বিষয়টা। একবার আমি ভুবনেশ্বর থেকে নয়া দিল্লি আসছি উড়ানে। উড়ানটিতে অর্ধেকের বেশি যাত্রী ছিলেন বিদেশি ভ্রমণার্থী। যাত্রা শুরুর কিছু পরে আমি শৌচালয়ে যাই। তার ঠিক পূর্বেই এক বিদেশি সেখান থেকে বেরোলেন। আমি ঢুকে দেখলাম বেসিন আর টয়লেটটি একেবারে পরিচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে। আমি আমার নিজের বহু দেশবাসীর কাছেই শৌচালয়কে এমন পরিচ্ছন্ন রাখার অভ্যাস দেখতে পাইনি। এই ধরনের অভ্যাসই জাতীয় চরিত্রের প্রতিফলন।
আমি প্রায়ই চিন্তা করি আমাদের জাতীয় চরিত্র গঠনের জন্য ঠিক কীসের প্রয়োজন। যাবতীয় পরিকল্পনা, বিনিয়োগ আর প্রকল্পগুলি যে স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যের দিকে এগোয়, তার শেষ ধাপটি অতিক্রম করতে কীসের প্রয়োজন আমাদের সব থেকে বেশি? আমি মনে করি প্রগতি আর উন্নয়ন, সামগ্রিক ছবিটার একটি অংশ মাত্র। এক ব্যক্তিমানুষের মতো, রাষ্ট্রকেও শিখে নিতে হয় কী করে কঠিন সময়েও নিজের অস্তিত্ব বহাল রাখতে হয়। এক ইতিবাচক দৃষ্টির ভারসাম্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে কী করে স্থিত রাখতে হয়। শিখে নিতে হয় কী ভাবে অন্যের সঙ্গে কাজ করে যেতে হয়। যে সব রাষ্ট্রে সমাজ বিবর্তিত হয়েছে, যাদের রয়েছে এক সুগভীর সাংস্কৃতিক শিকড়, যাদের আছে কার্যকরী শাসনব্যবস্থা ও তার সঙ্গে সুষ্ঠু আইন ও প্রশাসন, এবং যে সব রাষ্ট্রে ছেলেমেয়েদের ভিতর প্রোথিত করা হয় চিরস্থায়ী পারিবারিক মূল্যবোধ, সেই রাষ্ট্রগুলি একে অপরের সংযোগে তৈরি করে এক জনজাতি যারা সেই লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে যায়। প্রত্যেক নাগরিক তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে সমগ্র দেশের মানকে বৃদ্ধি করে।