ছয়: যুবসমাজ
একজন শিক্ষক, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে উঠে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়েছি। সংসদ এবং বিভিন্ন বিধানসভাগুলিতে রাজনৈতিক নেতা ও সদস্যদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। স্কুলগুলিতে আমার দেখা হয়েছে পড়ুয়া ও শিক্ষকদের সঙ্গে। ডাক্তার ও প্যারামেডিকাল স্টাফদের সঙ্গে দেখা হয়েছে হাসপাতালগুলিতে। দেশের দূর দূর স্থানে আমি মিলিত হয়েছি উপজাতি নেতাদের সঙ্গে। আমি যেখানেই গিয়েছি সেখানকার গোষ্ঠী বা তাঁদের পেশার কথা মাথায় রেখে আমি তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, এই শপথগুলি তাঁদের জীবনে প্রভাব ফেলে, অথবা খুব ক্ষুদ্রভাবে হলেও তাঁদের জীবনে পরিবর্তন এনে দেয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ, পূর্ববর্তী কোনও এক অধ্যায়ে আমি আমার ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেরালার ওয়্যানাড ভ্রমণের কথা লিখেছি। জহর নবোদয় বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সঙ্গে সেখানে আমার দেখা হয়েছিল ভোর ২.৩০-এর সময়ে। ওই সময়তেও তারা ছিল তরতাজা জীবনীশক্তিতে ভরপুর। তারা খুশি মনে আমার দেওয়া দশ দফার এই শপথটি পাঠ করেছিল:
১। আমার জীবনে একটি লক্ষ্য থাকবে যার জন্য আমি পরিশ্রম করব। আমি মনে করি লক্ষ্য ক্ষুদ্র হওয়া এক অপরাধ।
২। আমি নিষ্ঠার সঙ্গে আমার কাজ করব এবং সফলও হব সততার সঙ্গে।
৩। আমি আমার পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের ও বিশ্বের এক ভাল সদস্য হব।
৪। আমি সকল সময়ে সচেষ্ট থাকব কাউকে রক্ষা করতে বা তাঁর জীবনকে উন্নত করতে— তা তিনি যে-কোনও গোত্রের, বর্ণের, ভাষার, ধর্মের বা প্রদেশের হোন।
৫। আমি যেখানেই থাকি, যাই করি, আমি নিজেকে প্রশ্ন করব, ‘আমি কী দিতে পারি।’
৬। সময়ের গুরুত্ব আমি সকল সময়ে মনে রাখব। আমার মন্ত্র হবে: ‘আমার এই মুক্ত বিহঙ্গের সময়টিকে নষ্ট হতে দেব না।’
৭। আমি সকল সময়ে পরিচ্ছন্ন পৃথিবী আর পরিচ্ছন্ন শক্তির জন্য কাজ করব।
৮। রাষ্টের যুবসমাজের একজন হিসেবে নির্ভয়ে আমার সকল কাজে সাফল্য পেতে সচেষ্ট হব, এবং অন্যের সাফল্যে আনন্দ পাব।
৯। আমি আমার বিশ্বাসের মতোই তরতাজা এবং আমার সন্দেহর মতোই প্রাচীন। তাই বিশ্বাসের দীপশিখা আমার হৃদয়ে জ্বালিয়ে রাখি।
১০। জাতীয় পতাকা আমার হৃদয়ে সর্বক্ষণ উড্ডীন এবং আমার রাষ্ট্রের জন্য আমি নিয়ে আসব গৌরব।
একটি সমাজের, তার যুবজগতের স্বপ্ন, উদ্বেগ, ভাবনাচিন্তা, আশা আকাঙ্ক্ষার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত সকল সময়ে, কারণ ভবিষ্যত্টা তারাই নির্ধারণ করবে। ২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ হল কুড়ি বছরের নীচের জনগণ। আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, এই পৃথিবীর উপরনীচে সব থেকে শক্তিশালী সম্পদ হল প্রজ্বলিত যুবসমাজ। আমি নিশ্চিত যে, যুবশক্তিকে সঠিক পথে চালিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারলে মানবসমাজে রূপান্তর ঘটবে তার অগ্রগতি, নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা এবং সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি নিয়ে আসার জন্য।
পৃথিবীর সামনে যে মূল সমস্যাগুলি রয়েছে সেগুলি নিয়ে এবার আলোচনায় আসা যাক। দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী বাস করে দারিদ্র্যে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরাপদ পানীয় জল পাওয়া যায় না, ভাল শিক্ষার কথা তো বাদই দেওয়া হল। এই পরিস্থিতির সংস্কারে যুবসমাজ কীভাবে সাহায্য করতে পারে? একজন শিক্ষিত তার সারা জীবনে অন্তত পাঁচজনকে কী অক্ষর শিক্ষা করাতে পারে? জল সংরক্ষণের বার্তা যুবসমাজ কী প্রচার করতে পারে? চিরাচরিতের বাইরে তার বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের পথ কী বের করতে পারে?
কিছু বছর আগে Lead India ২০০২ নামে একটি অভিযান শুরু করি আমি। এটি মূলত একটি যুবসমাজের অভিযান। আমার দশ দফা শপথের উপর ভিত্তি করে এটি তৈরি করি। কারণ, আমি মনে করি, শিক্ষা, পরিবেশ, সামাজিক ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে এবং গ্রাম-শহর বিভাজন কমিয়ে আনতে যুবসমাজই সক্ষম। নিজস্ব লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা জাতীয় উন্নয়নেও ভাগ নেন। আমি আবারও বলি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য রেখে এগোনো এক অপরাধ। এক যুবক বা যুবতী নিজের জীবন বা পেশা গড়তে যে কাজ করেন তার সঙ্গেই তাঁর পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং সমগ্র মানবজাতির সেবায়ও নিয়োজিত থাকেন। প্রতিটিই অন্যের পরিপূরক।
আমার তৈরি এই শপথের পিছনে আছে কিছু তত্ত্ব, কিছু ছোট ছোট ঘটনা, এবং আছে বিভিন্ন ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চিন্তানায়কদের শিক্ষা। সেই প্রেক্ষিতের কাহিনিগুলি আপনাদের বলা যাক।
১। অন্যের জীবনকে রক্ষা কর বা তার উন্নতিসাধন কর
মহাত্মা গাঁধীর মা একবার তাঁকে বলেছিলেন: ‘পুত্র, তুমি যদি তোমার সারা জীবনে কোনও মানুষের জীবনকে রক্ষা করতে পার বা তাঁর জীবনে উন্নতি নিয়ে আসতে পার, তা হলে জেনো যে, তোমার মানবজীবন সার্থক। তুমি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য।’ এই পরামর্শ গাঁধীজির উপর গভীর প্রভাব ফেলে যা তাঁকে সারা জীবন মানবজাতির জন্য কাজ করে যেতে অনুপ্রাণিত করে।
২। ‘আমি’ শব্দটিকে নিজের দর্শন থেকে দূর কর
২০০৩-এ অরুণাচল প্রদেশ ভ্রমণের সময়ে আমি তাওয়াং-এ একটি ৪০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মনাস্ট্রিতে গিয়েছিলাম। সারাদিনই প্রায় সেখানে অতিবাহিত করি। ওই প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমি লক্ষ করলাম, সেখানকার আশপাশের গ্রামের মানুষদের ভিতর থেকে এক আশ্চর্যরকমের সুখানুভূতি নির্গত হচ্ছে। সেই মন্দিরের সব বয়সের ভিক্ষুদের মধ্যে দেখলাম এক প্রশান্তি। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তাওয়াং বা আশপাশের গ্রামগুলিতে কী এমন বস্তু আছে যার জন্য এখানকার মানুষজনের মধ্যে এত শান্তি বিরাজ করে। মনাস্ট্রির প্রধানকে আমি এই প্রশ্নটা করলাম।