আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি শিশুর নিজস্বতা ও মননশীলতাকে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে হবে। পাঠ্যসূচিকে করে তুলতে হবে উদ্ভাবনী। পরীক্ষা পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনে মুখস্থ বিদ্যার বদলে মননশীলতা ও নতুন চিন্তা যাতে প্রশ্রয় পায়, তাই দেখতে হবে। শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রদানের কেন্দ্র না হয়ে স্কুলগুলিকে জ্ঞান ও দক্ষতার উন্মেষ কেন্দ্র হতে হবে।
আমার নিজের জীবনের কিছু ঘটনা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। সুদূর ১৯৪৩ সালে আমার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন শ্রীশিবসুব্রহ্মনিয়া আয়ার [Sivasubramania Iyer]। এই দারুণ মানুষটি আমাদের বিজ্ঞান ও অন্যান্য কিছু বিষয় পড়াতেন। পাখি কী করে ওড়ে, এই বিষয়ে তিনি একদিন আমাদের পড়াচ্ছিলেন। তিনি বললেন যে, পাখির শরীরের আকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে তারা ডানা ঝাপটায়, কীভাবে গতি নেয়, এবং তাদের লেজ কীভাবে দিক পরিবর্তনে সাহায্য করে, এ সবই তিনি খুব সুন্দরভাবে বোঝালেন। কিন্তু আমাদের মনশ্চক্ষুতে আমরা তা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। আমার মনে আছে, তখন বাজে দুপুর ৩.৩০। তিনি আমাদের নিয়ে চললেন রামেশ্বরম দ্বীপের সমুদ্রতটে। সেখানে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আমরা সামুদ্রিক পাখির ওড়া দেখলাম। আমরা দেখলাম তাদের ডানা ঝাপটানো, গতি নিয়ে উড়ে যাওয়া, এবং লেজের সাহায্যে দিকের পরিবর্তন করা। ওই দিনটিতেই আমি জেনে গেলাম আমি কী করব। আমি উড্ডয়ন বিজ্ঞানের অধ্যায়ন করব। আমার শিক্ষক, তাঁর জীবন ও তাঁর শিক্ষাপ্রদান পদ্ধতি আমাকে আমার পথ বেছে দিল। ওই ক্লাসেই আমি আমার জীবনের ব্রত ঠিক করে ফেললাম।
অন্য ঘটনাটি ঘটেছিল যখন আমি তিরুচিরাপল্লীর [Tiruchirappalli] সেন্ট জোসেফস কলেজে পড়ি। সেখানে পড়াতেন তোটাদ্রী আয়েঙ্গার [Totadri Iyengar] নামে এক বিখ্যাত অঙ্কের শিক্ষক। প্রজ্ঞা যেন বিচ্ছুরিত হত যখন তিনি পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন। তরুণ শিক্ষার্থীরা সকলে বিস্ময়ে ও শ্রদ্ধায়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকত। আমার অঙ্কের অধ্যাপক ছিলেন অন্য একজন, যাঁকে সকলে ‘ক্যালকুলাস’ শ্রীনিবাসন নামে ডাকে। তিনিও অধ্যাপক আয়েঙ্গার সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আমার বিএসসি-র প্রথম বর্ষেই ক্যালকুলাস শ্রীনিবাসন কলেজের ম্যাথামেটিক্স ক্লাবে দশজন সদস্যর অন্যতম হিসেবে আমাকে নির্বাচন করলেন। এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার সবথেকে বড় লাভ হল, ক্লাবের সদস্যদের জন্য অধ্যাপক আয়েঙ্গারের বক্তৃতামালা শোনার সুযোগ। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, প্রথম দিনে অধ্যাপক আয়েঙ্গার তাঁর এক ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় প্রাচীন ভারতের অঙ্কশাস্ত্র আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের পণ্ডিতদের বিষয়ে বললেন। আমার এখনও কানে বাজে সেই বক্তৃতা, যেন গতকালই তা শুনেছি। আর্যভট্ট, ভাস্কর এবং আমাদের এখনকার সময়ের রামানুজম— অঙ্কশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুরোধা পুরুষ এবং অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষজনের কথা তাঁর কাছেই আমার প্রথম শোনা। এই দুই ঘটনা আমার শিক্ষা, জ্ঞান আহরণ ও মূল্যবোধের ভিত্তি হয়ে থেকে গিয়েছে।
তাঁর মতোই আমাদের স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের উচিত আত্মসমীক্ষা করা এবং বিচার করা যে তাঁরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে কতটা সাহায্য করছেন।
২। সংঘবদ্ধ দক্ষতা
আমাদের উচিত অর্থনৈতিক উন্নতিতে ও রাষ্ট্র গঠনে আমাদের সন্তানদের কর্মদক্ষতা প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া। মননশীলতা ও উদ্ভাবন এবং উদ্যোগী অধিনায়কত্বের জন্য যে গবেষণা বা অনুসন্ধিত্সার প্রয়োজন, তার সুযোগ করে দেওয়াও তার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সন্তানদের প্রয়োজন এই বিভিন্ন ধরনের দক্ষতাকে সুসংহত করে আলোকপ্রাপ্ত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা।
৩। সামাজিক ছুঁতমার্গের দূরীকরণ
আমাদের সন্তান, যারা ভবিষ্যতের নাগরিক, তাদের ভিতর মনের মিল এবং সাম্যবোধ সৃষ্টিতে শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সমাজে যে বিভিন্ন ধরনের ছুঁতমার্গ লক্ষ করা যায়, যেমন সামাজিক অবস্থান ও লিঙ্গ, বা অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষকদের কর্তব্য এমন ধরনের প্রভেদ তাঁদের ক্লাসঘর থেকে তথা শিক্ষার্থীদের মন থেকে দূর করে দেওয়া। কোনও পক্ষপাতিত্ব যেমন, সেই শিক্ষার্থী ছেলে না মেয়ে, ধনী না গরিব ঘর থেকে আসছে, অথবা কোন বিশেষ অঞ্চল থেকে আসছে বা কোন ধর্মের, এসব প্রশ্ন ছাড়াই যদি তাঁরা সকল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একরকম ব্যবহার করেন, তবেই ওই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব।
সুখী পরিবার
এক সুন্দর রাষ্ট্র নির্মাণের পরবর্তী পদক্ষেপ হল সুন্দর পরিবারের সৃষ্টি। আমি মনে করি একমাত্র সংযুক্ত সুখী পরিবারই পারে এক সুন্দর দেশের জন্ম দিতে। সুন্দর গৃহকোণের চারটি দিক আছে:
১। বই পড়ার অভ্যাস
পিতামাতা আর তাঁদের এক পুত্র আর এক কন্যা— অথবা দুই পুত্র আর দুই কন্যা— এই নিয়ে ধরা যাক একটি ছোট সংসার। পরিবারে পিতামাতা দু’জনেই উপার্জন করেন। আমি মনে করি এমন এক সংসারে নিদেনপক্ষে খান দশেক ভাল ভাল বইয়ের একটি সংগ্রহ আছে। রোজ সকালের জলখাবারের সময়ে অথবা রাতের আহারের সময়ে পিতামাতা যদি তাঁদের সন্তানদের বই পড়ে শোনান, তাহলে সন্তানদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস ঢুকে যাবে। নিজেদের মধ্যে এক সহজ যোগাযোগের স্বার্থে যে-কোনও একটি আহারের সময়ে অন্তত, সমগ্র পরিবারের একত্র হওয়া বাঞ্ছনীয়।