.
পাঁচ : একটি সুন্দর রাষ্ট্র
ধরুন এক ভ্রমণযাত্রী হিমালয়ের সুউচ্চ কোনও এক গিরিকন্দরে দাঁড়িয়ে তাঁর সম্মুখে উন্মীলিত সম্পূর্ণ দেশটিকে দেখছেন। তিনি কী দেখবেন? এক বৈচিত্র্যে ভরপুর ভূস্বর্গচিত্র তাঁর সামনে। সেখানে রয়েছে সব ধরনের গাছগাছালি, জীবজন্তু; নদ, নদী, নালা যারা গিয়ে পড়ছে ভূখণ্ডের তিন দিক ঘেরা সমুদ্রে; রয়েছে মরুভূমি, পাথুরে পর্বতমালা; শাল তরু এবং শত শত প্রজাতির গাছে ভরা ঘন জঙ্গল; এবং রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতির, বিভিন্ন ভাষার মানুষ যাঁদের সাহিত্য ভাণ্ডার এতটাই অসীম যে পণ্ডিতদের বহু জীবন লেগে যাবে তার অধ্যয়নে, আর তদুপরি আছে তাঁদের উষ্ণ আতিথেয়তা এবং নজরকাড়া স্বভাব। মূল ভূখণ্ডটিই সব নয়। বৈচিত্র্যপূর্ণ সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে বঙ্গোপসাগরে, মূল ভূখণ্ড থেকে ১৩০০ কিমি. দূরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে, আর আরব সাগরে মূল ভূখণ্ড থেকে ৪৫০ কিমি. দূরের লাক্ষাদ্বীপে।
এই অসীম সৌন্দর্যর সঙ্গে ভ্রমণযাত্রীর চোখে পড়বে অনেক কিছু অনভিপ্রেত বিষয়, যা সহজেই সংশোধন করে নেওয়া সম্ভব। যেমন, নদ-নদীর ক্রমবর্ধমান দূষণ; অরণ্যবিনাশ; পূতিগন্ধময় আবর্জনার মধ্যে স্যানিটেশন ব্যবস্থাহীন যত্রতত্র নগরায়ণ; অবহেলা ও বঞ্চনা; প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষার অভাব যা জনসংখ্যার বিরাট অংশকে গ্রাস করে রেখেছে, এমন বেশ কিছু বিষয়। সব থেকে নিকৃষ্ট যে বিষয়টি তাঁর চোখে পড়বে তা হল দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং বেকারত্ব। একটি সমাজকে অস্থির করে দেয় যে ক্রোধ ও হিংসা তা জন্ম নেয় এই পরিস্থিতিতেই। সমাজে স্থিতিশীলতা, শান্তির গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। এসবই নির্ভর করে জীবনধারণের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা কতটা উপলব্ধ হচ্ছে তার উপর। এইসবের উপর প্রত্যেক মানুষের পূর্ণ অধিকার আছে। অধিকার আছে সম্ভ্রম নিয়ে ও সম্মানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাঁচার। মূলত গণতন্ত্র হল এই সম্ভ্রম নিয়ে বাঁচা ও সম্মান আদায়ের জন্য ন্যায় ও ন্যায্য পথে এগোনোর সুযোগের প্রতুলতা। আমাদের সংবিধানের মূল বক্তব্যই তাই। একটি সত্যিকারের প্রাণিত গণতন্ত্রে জীবনযাপনকে সুখকর এবং আনন্দময় করে তোলে এইটিই।
এই ক্ষণে আমি সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের গণতন্ত্রের মসৃণ পথ চলা নির্ভর করছে আমাদের সকলে মিলে সমাজের সকলের মনের মিল ঘটানোতে। অন্যের চিন্তাধারা ও জীবনবোধের প্রতি যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা দেখা দিচ্ছে, যার প্রকাশ মানুষেরই বিরুদ্ধে আইনভাঙা হিংসা, তা যে প্রসঙ্গেই হোক, মেনে নেওয়া যায় না কোনওমতেই। আমাদের সকলকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং সভ্য আচরণে দৈনন্দিন জীবনকে চালিত করতে হবে যাতে অন্যের অধিকার সুরক্ষিত হয়। এই আমাদের গণতান্ত্রিক নীতিবোধের ভিত। ভারতবর্ষকে এক সুন্দর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে এই মূল্যবোধই।
আলোকপ্রাপ্ত মানুষ
সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে কেমনভাবে আমরা আলোকপ্রাপ্ত মানুষে বিবর্তিত হতে পারি? এর উত্তর আছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট কাজের মধ্যে। সন্তানের বিভিন্ন বয়সে যখন তার পিতামাতা কোনও কাজের জন্য তাকে ক্ষমতা প্রদান করেন, সে ধীরে ধীরে এক দায়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত হয়। শিক্ষক তাঁর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় যখন ক্ষমতাবান হন, ভাল নীতিবোধ নিয়ে মানুষের প্রকাশ ঘটে। প্রযুক্তির ক্ষমতাবলে সাধারণ মানুষ তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রকাশের সুযোগ পায়। কোনও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক যখন তাঁর অধীনস্থদের ক্ষমতা দেন তখন আরও অনেক পরিচালকের সৃষ্টি হয় যাঁরা দেশের পরিবর্তন আনতে পারেন বিভিন্ন দিকে। বিভিন্ন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা এনে দিলে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি নিশ্চিত। প্রতিটি ধর্মকে যদি ক্ষমতা দেওয়া হয় যাতে তারা আধ্যাত্মিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, তাহলে প্রতিজনের হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হবে সুখ ও শান্তি। এই ধরনের ক্ষমতায়নই পারে উত্তম মূল্যবোধ নিয়ে আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক তৈরি করতে।
আমি মনে করি আলোকপ্রাপ্ত মানবসমাজ তৈরি করতে প্রয়োজন তিনটি মূল উপাদান: নীতিজ্ঞানসম্পন্ন এক শিক্ষা ব্যবস্থা, দক্ষতার সুসংবদ্ধতা আর সামাজিক ছুঁতমার্গের বিলোপ।
১। উত্তম মূল্যবোধযুক্ত শিক্ষা
মানুষের জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল তার শৈশব। তাদের পাঁচ থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত, বাড়ি, স্কুল ও সমাজ থেকে তারা যে শিক্ষা পায়, তা-ই তাদের সারা জীবনকে তৈরি করে দেয়। এই পর্যায়েই তাদের প্রয়োজন হয় এক উত্তম মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার, যাতে তারা আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক হয়ে গড়ে ওঠে। এক প্রাচীন গ্রিক শিক্ষকের কথাগুলি মনে পড়ে যায়: ‘আমাকে সাত বছরের জন্য এক শিশু সন্তানকে দাও। তারপর ভগবান হোক বা শয়তান, নিয়ে যাক সেই শিশুকে। তাকে তারা আর পরিবর্তন করতে পারবে না।’ অভিভাবক ও শিক্ষক, এঁরা দু’জন মিলে স্থির করুন এক সুসংবদ্ধ লক্ষ্য: উত্তম মূল্যবোধের শিক্ষা— বাড়িতে এবং স্কুলে। ২৫,০০০ ঘণ্টার এই মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা থেকে যদি আমাদের সন্তানরা বঞ্চিত হয়, আমাদের এক সত্যনিষ্ঠ সমাজ স্থাপনের স্বপ্ন সার্থক হবে না। শিক্ষাই একটি স্বপ্নের রাষ্ট্র নির্মাণের মৌলিক উপাদান। আমাদের জনসংখ্যার এক বড় অংশ এই তরুণরা যাঁদের দক্ষতার উপর নির্ভর করেই আমাদের সমাজের যত প্রত্যাশা। ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্ভেপল্লী রাধাকৃষ্ণন একবার বলেছিলেন, ‘Education should be imparted with a view to the type of society that we wish to build. We are working for a modern democracy built on the values of human dignity and equality. These are only ideals; we should make them living forces. Our vision of the future should include these great principles.’ [‘কী ধরনের সমাজ আমরা গড়ে তুলতে চাই সেইটাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক রূপায়ণের নিয়ামক হওয়া আবশ্যক। মানবিক মর্যাদা ও সাম্যতার মূল্যবোধের উপর আমরা এক আধুনিক গণতন্ত্র গড়তে চলেছি। এ সবই শুধু তাত্ত্বিক স্তরে রয়েছে; তাকে বাস্তবে জীবন্ত করে তুলতে হবে। এই মহান তত্ত্বকে আমাদের ভবিষ্যতের লক্ষ্যে যুক্ত করতে হবে।’]