৮। বিচারক
সত্যকে তুলে ধরতে অভিগ্রস্ত পক্ষের সামাজিক অধিষ্ঠান বিচার্য নয়। দ্রুততার সঙ্গে বিচার সমাপ্ত করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে আইন অপরাধের প্রতিবন্ধক, তেমন আইন, উত্তম রোল মডেল আর কম বয়সে নীতিজ্ঞান শিক্ষা, এইসবই অপরাধ হ্রাসে সাহায্য করে। অন্যদিকে, সময় মতো বিচার পেলে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের নিন্দুক প্রবৃত্তিও হ্রাস পাবে।
৯। সংবাদমাধ্যম
সদা সজাগ ও অতিক্রিয়াশীল থাকতে হবে সংবাদমাধ্যমকে। তবে তাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে উত্তেজনাকে ইন্ধন জোগাতে গিয়ে সত্যের অপলাপ না হয়ে যায় অথবা কোনও বিষয় পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে পড়ে।
১০। শিল্পী ও লেখক
ইতিহাস, সাহিত্যর মতো কলা বিষয়ে চর্চা করেন যাঁরা, তাঁরা সারা দেশের মনোজগৎকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, দেশের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে দেশের সম্ভাবনাময় গুণগুলিকে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরার কাজ ছাড়াও, তাঁদের উচিত নিজস্ব চিন্তাধারাকে প্রকাশ করা, গণতান্ত্রিক উপায়ে কোনও বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করা।
১১। নন-গভর্নমেন্টাল ও কল্যাণকারী সংগঠন
তাদের প্রবল উদ্দীপনাপূর্ণ দায়বদ্ধতার জন্য নন-গভর্নমেন্টাল সংগঠনগুলি খ্যাত এবং তাদের কর্মোদ্যোগ, নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে তারা দেশে দর্শনীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা সকলে, তা যে যা পেশাতেই যুক্ত থাকি না কেন, সংবিধানে নির্দিষ্ট যে আচরণবিধি আছে তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। বিচক্ষণতার সঙ্গে আমরা আমাদের প্রতিটি কাজ করব এবং আমাদের প্রতিটি কার্যাবলি সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকব। আমি একজন নাগরিক হিসেবে এ কথা সোচ্চারে উচ্চারণ করছি, কারণ আমি দেখেছি কম সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ আইনের সুফল পান না। যাঁদের উপর সুযোগ-সুবিধা বর্ষিত হয় তাঁদের উচিত যোগ্য সম্মান দিয়ে তার সদ্ব্যবহার করা। যাঁদের কাছে সেই সুযোগ সুবিধা নেই তাঁদের ক্লেশ দেবার জন্য তা ব্যবহার করা সমুচিত নয়। এবং অবশ্যই তা জাহির করার জন্য নয়। অধিকার আস্ফালনের জন্য নয়, তাকে সঠিক কাজে লাগানোটাই কর্তব্য। সৌজন্য ও সংযমের মতো গুণগুলি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে লালন করা প্রয়োজন।
গণতন্ত্রের যে তিনটি স্তম্ভ— আইনসভা, প্রশাসন ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা— তারা যত শীঘ্র বুঝবে যে, এক স্বাস্থ্যকর প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থায় একটির অন্য দু’টি ছাড়া কোনও অস্তিত্ব নেই, ততই মঙ্গল আমাদের পক্ষে। আমাদের চেষ্টা হবে নাগরিকদের আশা আকাঙ্ক্ষাকে পোষণ করে এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যেখানে সত্যিকারের গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারবে। সেইটিই হবে এক স্বাস্থ্যকর পুনরুদীয়মান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযুক্ত পরামর্শ।
২০১৩ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমার এক বক্তৃতার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই। মেরিল্যান্ডে জগদ্গুরু শ্রীশিবরাত্রীস্বর (জেএসএস) প্রতিষ্ঠানে কিছু মানুষের সামনে ‘Evolving a World without War’ বিষয়ে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। বক্তৃতাশেষে আমি লক্ষ করলাম যে, মার্কিন শ্রোতারা আমাকে আমার বক্তব্যের উপর প্রশ্ন করলেন বা পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ভারতীয় শ্রোতারা আমায় যা প্রশ্ন করলেন, তা সাধারণ বিষয়ে, যা আমার বক্তব্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এর থেকে আমি এই বার্তাই দিতে চাইছি যে, বক্তার বক্তব্য অনুধাবন করার অভ্যাস করতে হবে আমাদের, এবং সেই মতো প্রশ্নগুলিকে সাজিয়ে নিতে হবে। তাহলেই সমগ্র আলোচনাটি ফলপ্রসূ হবে।
এই ঘটনা আমাকে একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একটি রাষ্ট্র হিসেবে আমরা কি নিজেদেরকে সঠিক প্রশ্ন করছি? প্রাসঙ্গিক সমস্যার বিষয় বলতে গিয়ে আমরা কি বিমূর্ত কিছু কথা বলে বসি? আমরা এমন সমাধানসূত্র দিই যা হয়তো পাঁচ বছর পর কাজে আসবে, কিন্তু এই মুহূর্তে কোনও সুবিধা হবে না। আমরা অন্তরিক্ষ অন্বেষণের কথা বলি অথচ পায়ের নীচের পথটি সারানোর কথা ভাবি না।
একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি এমন হওয়া উচিত যা হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এবং তার জন্য প্রয়োজন সঠিক প্রশ্ন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার শক্তি থাকে জ্ঞানে। জ্ঞানের শক্তি প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির শক্তি লুকিয়ে থাকে উদ্ভাবনীতে। জ্ঞানের সমাজে, আমাদের সর্বক্ষণ উদ্ভাবন চালিয়ে যেতে হবে। উদ্ভাবন নতুন নতুন জ্ঞানের রাস্তা উন্মোচন করে দেয়। তার ফলে কল্পনার নতুন দিক খুলে যায়। ফলে আমাদের কল্পনাতে যুক্ত হয় নতুন নতুন পরত যা দৈনন্দিনতাকে করে তোলে অনেক অর্থবহ এবং সমৃদ্ধ, বিষয়ে এবং গুরুত্বে। মননশীলতা জন্ম দেয় উদ্ভাবনকে। এবং মননশীলতা আসে সুন্দর মন থেকে। সুন্দর মন পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় পাওয়া যাবে— মত্স্যজীবী পল্লিতে, বা কৃষকের ঘরে, ক্লাসরুমে বা ল্যাবরেটরিতে, শিল্পে বা আর-অ্যান্ড-ডি কেন্দ্রে। মননশীলতা দিয়ে আমরা সারাক্ষণ আমাদের চিন্তাভাবনাকে উন্নততর করে তুলতে পারি। আমাদের কাজে পরিবর্তন ও পরিশোধন এনে নতুন নতুন সমাধানে উপনীত হতে পারি। মননশীলতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সবাইকার মতোই কোনও কিছু নিরীক্ষা করে অন্যকিছু ভাবে তাকে চিন্তা করা। উদ্ভাবন ও মননশীলতা পরিশেষে শ্রেষ্ঠত্বের আবাদ করে— সুন্দর মন থেকে জন্ম হয় এক সুন্দর রাষ্ট্রের।