‘আশ্রম থেকে প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও বনৌষধি সম্পর্কে জ্ঞাতব্য স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রচার করা হয়। গবাদি পশুর চিকিৎসাও হয়।’ বাবা এরপর বললেন, ‘কালাম জানেন, গ্রামবাসীরা এতটাই তৃপ্ত এই ব্যবস্থায় যে, এই গোশালার গোরুদের খাদ্য তাঁরাই জোগাড় করে আনেন। যখন গোরু দুধ দেওয়া শুরু করে আমি গ্রামের যাঁরা দুঃস্থ তাঁদের বিনাপয়সায় দুধ, মাখন দিই— আর দিই এই গ্রামে আসা অতিথিদের… যেমন আপনি, কালাম!’ বলে হেসে উঠলেন আর আমার গেলাসে ঢেলে দিলেন আরও দুধ।
‘পরিশেষে একটি প্রশ্ন আপনাকে করি, বাবা’, আমি বললাম। ‘এই বনৌষধির বিষয়ে বা গোরুদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য কাজকর্মের বিষয়ে আপনি কোথা থেকে জানলেন?’
বাবার চোখ দু’টি মরুর আলোকোজ্জ্বল তেজের মতো জ্বলে উঠল। ভূগর্ভস্থ গ্রন্থাগারটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওইখান থেকে।’
ভাদারিয়া থর মরুভূমির মাঝে একটি ছোট্ট গ্রাম। কিন্তু সে সারা বিশ্বকে এক অমূল্য পাঠ শিখিয়েছে। সুসংহত উন্নয়নের এক আদর্শ নিদর্শন এই গ্রাম— যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্ঞানের প্রসার, স্বাস্থ্য পরিষেবা, গবাদি পশুর রক্ষণাবেক্ষণ, পশুখাদ্যের সুষম পরিচর্যা— এই সবকিছুই ঘটেছে মরু অঞ্চলে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে পরম্পরাগত জ্ঞানের এক অদ্ভুত মিলনে, এই অঞ্চলের জমি, সম্পদ, এমনকী মানুষের জীবনে এসেছে এক অত্যাশ্চর্য রূপান্তর। শ্রেষ্ঠত্বের পথে উত্তরণে এইটিই মৌলিক দিক, যা আমরা এই গ্রন্থে আলোচনা করছি। তা কেবল একটি রাষ্ট্রের নয় বা এক রাষ্ট্রগোষ্ঠীর বিষয় নয়, তা সমগ্র বিশ্বের মানব গোষ্ঠীর জন্য মূল্যবান।
.
চার : হাতে হাত
ভাদারিয়ার ক্ষেত্রে যা সত্য, তা যে-কোনও সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রেই সত্য। সার্বিক বৃদ্ধি ও অগ্রগতির জন্য জীবনের বিবিধ দিকের একযোগে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন। যত ধরনের ব্যবস্থা কায়েম আছে তাদের সকলেরই অভিমুখ কিন্তু এক হওয়া চাই। এবং তাকে হতে হবে স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ। তবেই পাওয়া যাবে উন্নয়নের প্রতি স্থির লক্ষ্যে এক সুসংহত প্রয়াস। বিবিধ জটিল সমস্যা আমাদের রাষ্ট্রকে জর্জরিত করে রেখেছে। কিন্তু জাতীয় উন্নয়ন যেহেতু লক্ষ্যের মূলে তাই এই সমস্যাগুলি এক ধরনের নিরপেক্ষতায় যথাযথ সময়ের ভিতরে সমাধান হয়ে যায়। কীভাবে প্রতিটি ব্যবস্থার নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্যের দিকে নিষ্ঠাভরে কাজ করা বাঞ্ছনীয়, তা আমি বুঝিয়ে বলছি।
১। রাজনৈতিক নেতা
রাষ্টের সামনে একটি লক্ষ্য স্থির করে উন্নয়নমূলক রাজনীতির মাধ্যমে নাগরিক সমাজের সামনে একটি দৃষ্টান্ত রাখার প্রয়োজন আছে রাজনৈতিক নেতাদের। রাজনৈতিক নেতাদের উচিত দেশের আইনব্যবস্থার উপর শ্রদ্ধাশীল হওয়া। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে যেন সেই আইন লঙ্ঘিত না হয়, সে দিকেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
২। আইনপ্রণেতা
আইনকে সরল করার প্রয়োজন এবং পুরনো অপ্রাসঙ্গিক অ্যাক্টগুলিকে একটা নির্ধারিত সময় অন্তর বাতিল করে দেওয়া। এমনই ব্যবস্থা হওয়া উচিত যেখানে বিচার হবে ন্যায্য এবং তাড়াতাড়ি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আইনবিষয়ক ধারণা দেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে তা প্রথাগতভাবে হোক বা অন্য উপায়ে— বিশেষ করে গ্রামের মানুষদের জন্য।
৩। নাগরিক
প্রত্যেক নাগরিকের অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। ন্যায্য সঠিক কারণে আইনব্যবস্থাকে কাজে লাগানো উচিত, নিজেদের তুচ্ছ কারণে নয়। এ ছাড়া, নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া যে-কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতার সঙ্গে তাঁদের সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেওয়া উন্নতির জন্য অনুকূল অবস্থা তৈরি করে দেয়।
৪। শাসনব্যবস্থা
সমাজের পরিবর্তন ও মানুষের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে শাসনব্যবস্থাকে হতে হবে সংবেদনশীল এবং অতিক্রিয়াশীল। প্রযুক্তি, যেমন ই-গভর্নেন্সের মতো ব্যবস্থা, তার সাহায্যে সিদ্ধান্তকে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কার্যকরী করতে হবে।
৫। পুলিশ
সুশীল নাগরিকের সামনে সার্বিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ও বরাভয় জোগানো পুলিশের কর্তব্য। তাদের বিচার যেন বহিরাগত কোনও চাপের মুখে পরাজিত না হয়ে যায়। সত্যনিষ্ঠ আধিকারিকদের কর্তব্য সমাধা করতে যেন সব সময়ে একটা নিরাপত্তা দেওয়া হয়। পুলিশের কাজের ভিত্তিতে তাঁদের যথাযথ বেতন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া উচিত।
৬। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ
উন্নতির যে কাজ তাতে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদকে হতে হবে সহযোগী। দ্রুত গতিতে উন্নয়নের জন্য চাই উদ্ভাবনী সমাধানসূত্র। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সমাজের সব স্তরের মানুষকে ওয়াকিবহাল করতে হবে যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হতে পারে দ্রুত।
৭। আইনজ্ঞ
আইন ব্যাবসা শুধুই একটি ব্যাবসা নয়— সমাজে সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার দায়ও তার। আইনের চর্চা করেন যাঁরা, তাঁদের উচিত, তাঁদের পেশাদারি নীতিজ্ঞান বজায় রেখে চলা। আইন স্কুলগুলিতে শিক্ষার্থী আইনজীবীদের ভিতরে এই মূল্যবোধ প্রোথিত করে দিতে হবে তাঁদের পেশাদারি জীবনের গোড়াতেই, যাতে তাঁরা যখন তাঁদের পেশায় বরিষ্ঠ হয়ে উঠবেন, নতুন প্রজন্মের কাছে তখন যেন তাঁরা রোল মডেল হয়ে ওঠেন।