কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর, কয়েকটি হাত উঠে এল।
এক তরুণ অফিসার উঠে আমাকে একটা দুর্দান্ত স্যালুট ঠুকে বেশ উচ্চস্বরে বললেন, ‘স্যার, আমি যখনই চিনাদের হিমালয়ে আমাদের থেকে উঁচুতে দেখি, তখনই আমার মনে আসে আমার তাওয়াং যাওয়ার কথা। আমার সব থেকে বড় উচ্চাশা হল, আমি যেন চিনাদের যে-কোনও আগ্রাসন পরাস্ত করে দিতে পারি।’
আর একজন যোগ দিলেন, ‘স্যার, যে ৫০,০০০ বর্গ কিমি. আমাদের দেশের অংশ চিনাদের কবলে রয়েছে, তা উদ্ধার করে আনা হল আমার জীবনের অভিপ্রায়। আমি আমার শেষ নিশ্বাস দিয়ে তার জন্য লড়ে যাব।’
স্থানীয়রা করতালি দিয়ে স্বাগত জানিয়ে ক্রমাগত আওড়াতে লাগলেন, ‘জয় হিন্দ! জয় হিন্দ!’ আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম জওয়ান, অফিসার এবং স্থানীয়দের এই সুদৃঢ় মনোবল আর অটল সংকল্পের মানসিকতা দেখে। আমাদের এই সব অঞ্চলকে যেমন লালন করতে হবে, তেমনই এই স্পিরিটটা বা মানসিকতাটাকেও জিইয়ে রাখতে হবে।
ভাদারিয়া, রাজস্থান, মে ১৯৯৮
দেশের একেবারে পূর্ব থেকে ৩০০০ কিমি. ভারতের বুকের উপর দিয়ে পেরিয়ে, যাওয়া যাক পশ্চিমে। সেটা ছিল ১৫ মে, ১৯৯৮, ভারত, তার প্রতিরক্ষার মানকে সুউচ্চ স্তরে তুলে, সবে সাফল্যের সঙ্গে তার পাঁচটি আণবিক পরীক্ষা করেছে, ১১ মে ও ১৩ মে। সারা রাষ্ট্র উত্ফুল্ল। আমি এবং আমার বিজ্ঞানীদের দল যেখানে পরীক্ষাগুলি সংঘটিত হয়েছিল, সেই পোখরান থেকে ফিরছি। থর মরুভূমির অভ্যন্তরে অবস্থিত পোখরানে জীবনের প্রায় কোনও চিহ্নই নেই। মে মাসের ওই সময়টায় প্রচণ্ড গরম, তাপমাত্রা ৫০˚ সে. ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং মরুভূমির বালি যেন ফুটছে।
এঁকেবেঁকে মরুপথে ফেরার সময়ে আমরা পেলাম একটি ছোট গ্রাম— ভাদারিয়া। রাস্তায় জায়গাটির বোর্ড দেখে আমার এক সহকর্মী উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন যে, ওই জায়গার নাম তিনি আগে শুনেছেন। ওখানে নাকি একটি বিখ্যাত আশ্রম আছে। তাঁর অনুরোধে আমরা স্থির করলাম সামান্য ঘুরপথ হলেও আমরা ওই স্থানটিতে যাব।
ভাদারিয়া আসলে একটি ছোট হ্যামলেট বা যাকে পল্লি বলা যায়। আশ্রমটি খুঁজে পেতে তাই বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু সেখানে আমরা যা দেখলাম তা বিশ্বাস করা কঠিন। একটি বিশাল জায়গা নিয়ে সবুজ বনানীতে ঢাকা মরুর মধ্যে এই স্থানটি। আশ্রমের প্রধান, বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ, আমাদের অভ্যর্থনা করে জানতে চাইলেন, আমরা তাঁর তৈরি গ্রন্থাগারটি দেখতে ইচ্ছুক কিনা। তিনি সিঁড়ি দিয়ে আমাদের একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে নিয়ে গেলেন। সেই কক্ষ দিয়েই ঢুকতে হয় গ্রন্থাগারটিতে।
ঘরটি অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ আমাদের জানালেন, ঘরটির পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যে, বাইরে যতই তাপ বৃদ্ধি পাক, গ্রন্থাগারের ভিতরটা থাকবে ঠান্ডা। বিভিন্ন বিষয়ের, বিভিন্ন ভাষার, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের উপর বই দেওয়াল জোড়া। কিছু ছিল বল্কলের উপর হাতে লেখা। বাবা শ্রীভাদারিয়া মহারাজ আমাদের কয়েকশো বছরের পুরনো বই দেখালেন। তিনি জানালেন যে, প্রাচীন ঐতিহ্যশালী জ্ঞানভাণ্ডারকে তাঁর আশ্রম বহু যুগ ধরে সংরক্ষণ করে আসছে।
তাঁর গ্রন্থাগারে বসে আমরা যখন তাঁর বইগুলিতে মশগুল, তিনি আমাদের সকলকে বড় বড় গেলাস ভর্তি দুধ এনে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাবা, এই মরুভূমিতে এমন চমকার টাটকা দুধ আপনি কোথায় পেলেন?’
তিনি হেসে আমাকে তাঁর সঙ্গে আসতে বললেন। আশ্রমের পিছনে একটি বিশাল গোশালায় তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে রয়েছে শয়ে শয়ে গোরু। তিনি বললেন, ‘কালাম, এই গোরুগুলি সব পরিত্যক্ত। দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় এদের মানুষ পরিত্যাগ করেছে। তাদের কাছে এই গোরুর কোনও মূল্য নেই। কিন্তু আপনার মতোই আমিও এক প্রযুক্তিবিদ।’ এই বলে তিনি হাসলেন। ‘আমি একটি বিশেষ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এই পরিত্যক্ত গোরুদের আবার সুস্থ সবল করে তুলেছি। তারা আবারও দুধ দিচ্ছে— যা আপনার হাতের গেলাসে আপনি ধরে আছেন।’
আমি মুগ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছিলাম, এমন এক মহিমান্বিত কর্মযজ্ঞ— এক মিশন। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কিন্তু বাবা, আপনি এদের খাদ্য কোথা থেকে জোগাড় করেন?’
তিনি আমাকে গাছের ছায়ায় একটি খাটিয়াতে বসতে বলে ভাদারিয়ার রূপান্তরের কাহিনি শোনালেন। তিনি বললেন, ‘বহু বছর আগে এই অঞ্চলের মানুষরা ছিলেন ভীষণ গরিব। তাঁরা নানা রকম নেশা করতেন সিগারেট, মদ থেকে, স্থানীয় আগাছা থেকে উৎপন্ন মাদক। জায়গাটা ছিল একেবারেই অনুর্বর, নিষ্ফলা। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব, অপুষ্টি ইত্যাদির মতো নানান সামাজিক সমস্যা ছিল। জলের জোগান ছিল অপ্রতুল, আর যতটুকু পাওয়া যেত তাও বিনা তত্ত্বাবধানে নষ্ট হত। এখন দেখুন আমরা গ্রামবাসীদের সহযোগিতা এবং সমর্থনে কী করে ফেলেছি। নেশা-মুক্তির শিবির খোলা হল এই আশ্রমের ভিতরেই। আজ ভাদারিয়ার আশপাশে প্রায় সত্তরটি গ্রামে তা চলছে। লক্ষ লক্ষ গাছ রোপণ করে স্থানীয়দের সহযোগিতায় আমরা ভাদারিয়া ও তার আশপাশ অঞ্চলে সবুজায়ন অভিযান করেছি। টিউবওয়েল বসানোর কাজের ফলে এই এলাকায় কৃষিকাজ শুরু হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে জল সংরক্ষণের কাজও শুরু হয়।