এই অনুষ্ঠান শেষে পূর্ণ উদ্যম নিয়ে পৌঁছে গেলাম জহর নবোদয় বিদ্যালয়ে ভোর ২.৩০ মিনিটে। সেখানে তখন জড়ো হয়েছে ওয়্যানাডের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। একটি অনুষ্ঠান বা মিটিং-এর জন্য সময়টি ছিল অ-সাধারণ। কিন্তু অবাক করার বিষয় হল যে, তারা প্রত্যেকেই ছিল মনোযোগী। অনুষ্ঠান শেষে এক পড়ুয়া জানতে চাইল, ‘স্যার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কী করে অশিক্ষাকে দূর করতে পারে?’ আমি তাকে একটি দারুণ উদাহরণ দিলাম, যার পরিচয় আমি কিছু ঘণ্টা আগেই পেয়েছি: অরিভিদম।
ঊরি, ঊর্সা আর তাংধার, জম্মু ও কাশ্মীর, অক্টোবর ২০০৫
কেরালা থেকে যাওয়া যাক কাশ্মীরে। ২০০৫ সালের অক্টোবরে কাশ্মীর উপত্যকায় এক ভয়ানক ভূমিকম্প জীবন ও সম্পত্তির প্রভূত ক্ষতি করে। বিশালাকার সেই উদ্ধার আর পুনর্বাসনের কাজ কেমন চলছে তা দেখার জন্য আমি পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ঊরি, ঊর্সা আর তাংধারে গিয়েছিলাম।
সেখানকার স্থানীয় মানুষ যার সংখ্যাগরিষ্ঠই কৃষক, সরকারের প্রতিনিধি, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একটি মিটিং-এ যোগ দিয়েছিলাম। মিটিং-এ আমি তার আগের দিন ওই তিনটি জায়গা পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে বললাম যে, আমার বিশেষ করে নজরে পড়েছে যে, সেখানে জীবনধারণের কোনও আয়োজন নেই। আমি স্থানীয়দের প্রশ্ন করলাম যে, কেন তাঁরা তাঁদের জমিতে ফল, বিশেষ করে কাশ্মীরের জগৎ-বিখ্যাত আপেল, ফলান না।
তাঁরা জানালেন, ‘স্যার, আমাদের কোনও জমি নেই। আমাদের সব জমি সেনাবাহিনীর হাতে।’
তাঁদের এই উত্তর আমাকে অবাক করে দিল। কিন্তু আমার সঙ্গে যেসব আধিকারিকরা ছিলেন তাঁরা একটু হতচকিত হয়ে পড়লেন। আমি রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী এবং সেনার বরিষ্ঠ অফিসারদের দিকে তাকালাম। একটা যেন অস্বস্তিকর নীরবতা চেপে বসেছে। আমি জানতাম আমাকেই এর উত্তর দিতে হবে। আমি বললাম, স্থানীয়দের এই অসুবিধা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত। তাই কিছু জমি চিহ্নিত করে তা ফসল ফলানোর জন্য রাখতেই হবে— এবং তাতেই ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব। বাজারের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগ ব্যবস্থার বিষয়ের উপরও জোর দিলাম। ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেন তার সীমান্তবর্তী এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। বস্তুত, সকল সামাজিক অশান্তিকে প্রশমিত করার সব থেকে উত্তম পথ হল উন্নয়ন।
কিবিথু, অরুণাচল প্রদেশ, মার্চ ২০০৭
২০০৭ সালে, আমার রাষ্টপতি পদে থাকার শেষ বছর, সামরিক বাহিনীর প্রধান, জেনারাল জোগিন্দর যশবন্ত সিংহ অরুণাচল প্রদেশে ভারতের সঙ্গে চিনের সীমান্ত একবার ঘুরে আসার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। এই জেনারালটি, যাঁকে সকলে জেজে নামেই ডাকেন, হলেন একজন বহুদিনের সেনানী যাঁর ছিল অত্যন্ত দৃঢ় অথচ সকলকে অভিভূত করে রাখার মতো এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব। আর ছিল তাঁর চিরহরিৎ হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। সুতরাং, তিনি যখন জোর দিয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন সীমান্তের সেনা জওয়ানদের সামনে বক্তব্য রাখতে, আমি তত্ক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম।
কিবিথু নামের একটি স্থানে আমরা পৌঁছলাম। এখানে মিলেছে চৈনিক আর ভারতীয় অঞ্চল। আমরা ছিলাম একটি উপত্যকায় যাকে ঘিরে পর্বতমালা আকাশকে ছুঁয়েছে। ওপারে দেখা যাচ্ছিল চিনা শিবির, আমাদের থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত। সেখানকার কিছু অনুসন্ধিত্সু সৈনিক জড়ো হয়ে দেখছিল আমাদের এখানে আসা নিয়ে এখানকার ব্যস্তসমস্ত কার্যকলাপ। আমি বিশাল হিমালয়ের প্রেক্ষাপটে তাকিয়ে দেখছিলাম আমাদের তরুণ সেনানীদের আর ওই অঞ্চলের কিছু স্থানীয় মানুষদের যাঁরা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। আমাদের সৈনিকদের ওই কঠিন পরিস্থিতির সাহসী মোকাবিলা, আমাকে মুগ্ধ করে দিল। আমরা যতই তাঁদের জন্য সবরকম ব্যবস্থা করি না কেন, হিমালয়ের যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন বাস্তব হল সেখানকার সব থেকে বড় প্রতিপক্ষ, পার্শ্ববর্তী দেশের সেনাদের থেকেও, সেখানকার কঠিন আবহাওয়া।
এরপর আমি স্থানীয়দের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। তাঁদের বেশিরভাগই উপজাতি সম্প্রদায়ের। তাঁদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর উল্লসিত চেহারা। কিন্তু তাঁদের দারিদ্র্য ও কঠিন জীবনকে তা ঢেকে দিতে পারল না। তাঁদের জীর্ণ শরীর, অতিরিক্ত কর্মে ক্লান্ত হাত দু’খানি বা দীর্ণ পোশাক জানিয়ে দিচ্ছিল তাঁদের অবস্থা। এই সব সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কোনও অতিরিক্ত সাহায্য ছাড়াই যে-পরিমাণ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করেন তার তুলনা নেই। সেনার কাজে সাহায্যর জন্যও তাঁদের বহু অতিরিক্ত কাজ যেমন করতে হয়, তেমনই তাদের কিছু লজিস্টিক কাজেও সাহায্য করতে হয়। তাঁদের পাশ দিয়ে আমি যখন হেঁটে যাচ্ছি, আমার কানে এল এমন উপজাতীয় এলাকার অতি পরিচিত অভিবাদন: ‘জয় হিন্দ’।
এরপর আমি সংযুক্ত স্থলসেনা কমান্ডের উদ্দেশে বক্তৃতা দিলাম। আমি লক্ষ করলাম, ওই কঠিন পরিবেশ সত্ত্বেও, সাধারণ জওয়ান ও অফিসারদের তাঁদের কর্তব্যকর্মের প্রতি এক অদ্ভুত উদ্যম। লক্ষ করলাম যে-কোনও চ্যালেঞ্জ, তা আবহাওয়া হোক বা ওপারের হুমকিই হোক, তার জন্য তাঁরা চিরপ্রস্তুত। বক্তৃতার শেষে কয়েকজন তরুণ অফিসারের সঙ্গে আমার আলাপ হল।
আমি তাঁদের বললাম, ‘আপনারা রাষ্ট্রের ও তার মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দিনরাত কাজ করে চলেছেন— আপনাদের জন্য আমি গর্বিত। আপনাদের প্রত্যেকের বহু যত্নে পোষণ করা সব থেকে ঈপ্সিত স্বপ্নের কথা এবার আমাকে বলুন।’