কী অপরূপ রীতি। ভালবাসা, স্নেহ, অনুকম্পার এই যে সঞ্চারণ, তা সারা রাষ্ট্রে এবং সারা বিশ্বে সংরক্ষিত ও লালিত হওয়ার প্রয়োজন। আমরা যখন উন্নতির কথা বলি, আমাদের চিন্তায় এই বিষয়টি রাখতে হবে অবশ্যই।
ওয়্যানাড, কেরালা, ফেব্রুয়ারি ২০১১
চলুন আপনাদের পশ্চিমে ১২০০ কিমি. দূরে কেরালায় নিয়ে যাই। ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে আমাকে একটি অনন্য শিক্ষা প্রকল্পের উদ্ঘাটনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ওয়্যানাড জেলা শিক্ষা দপ্তর। ওই দিনই জহর নবোদয় বিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্কুল পড়ুয়াদের সঙ্গে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। আমার কিছু সহকর্মীর সঙ্গে সকাল ৯.৩০ মিনিটে আমার ব্যাঙ্গালোরের পথে দিল্লি থেকে রওনা হওয়ার কথা ছিল। ব্যাঙ্গালোর থেকে কালিকাটের প্লেন ধরে ৩.৩০-এ সেখানে পৌঁছে গাড়িতে ওয়্যানাডের ৫টার অনুষ্ঠানে পৌঁছনোর কথা। যাত্রার প্রতিটি বিষয় নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত হয়েছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার কারণে যে-কোনও নিখুঁত পরিকল্পনাই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
দিল্লি বিমানবন্দরে আমরা ঠিক সময়েই পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আমাদের জানানো হল যে, কিছু অনিবার্য কারণে ব্যাঙ্গালোরের প্লেন ছাড়তে দেরি হবে। প্রথমে, আমাদের মনে হয়েছিল যে, হয়তো কিছু মিনিটের মধ্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক কাটার পর, আরও এক ঘণ্টা, তারপর আরও-ও এক ঘণ্টা কেটে গেল। প্রতীক্ষালয়ে বসে আমরা আমাদের বক্তৃতাগুলি ঝালিয়ে নিলাম, বই পড়লাম। শেষে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছতে ৫.৩০টা বেজে গেল। আমাদের কালিকাটগামী সংযোগকারী প্লেন বহুক্ষণ আগেই স্বাভাবিকভাবে ছেড়ে চলে গিয়েছে । ওয়্যানাডের ছেলেমেয়েদের এবং অন্যান্যদের কথা চিন্তা করে আমি সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা জানালাম।
তাঁরা আমায় বললেন, ‘স্যার, আমরা কেউই এখান থেকে একটুও নড়ছি না। আপনার অপেক্ষায় প্রয়োজনে আমরা এখানে সারা রাত থাকব। আমরা জানি আপনি কখনওই আমাদের অসন্তুষ্ট করবেন না।’
আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম, এবং ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক ওয়্যানাড আমরা পৌঁছবই। বিভিন্ন উপায় আলোচনা করে ঠিক হল, গাড়ি নিয়ে কয়েকশো কিলোমিটার কেরালার ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গেলে ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাব। আমার ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছ’টা। যত তাড়াতাড়িই যাই মধ্যরাতের আগে আমরা ওয়্যানাড পৌঁছতে পারব না। আমি সেইভাবেই যাওয়া মনস্থ করলাম এবং সংগঠকদের তা জানিয়ে দিলাম।
শুরু হল আমার জীবনের দীর্ঘতম একনাগাড় পথযাত্রা। ১০০ কিমি.-র আগেই, ওই রাস্তাটি বাদে, মানবসভ্যতার সব চিহ্নই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল— শুধু পড়ে রইল সবুজ বনানী তার একান্ত নিজস্ব দৃশ্যাবলি ও শব্দগুচ্ছ নিয়ে। ওই চন্দ্রাভিষিক্ত রাত্রিতে আমাদের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখছিলাম গাছের লম্বা লম্বা ছায়াগুলি। মাঝে মাঝে আমাদের গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল হাতির পালের আওয়াজ। বনাঞ্চলের এই বিশাল সম্পদ যেন আমাদের সামগ্রিক জাতীয়সম্পদের এক সাক্ষ্য বহন করছে।
কোথাও না থেমে দীর্ঘ সাড়ে ছ’ঘণ্টার পথ অতিক্রম করার পর আমাদের স্বাগত জানাল একটি সাইনবোর্ড যাতে লেখা, ‘ওয়্যানাডে স্বাগত’। শহরে ঢোকা মাত্রই মোবাইল ফোনের যোগাযোগ আবারও পাওয়া গেল, আর রাতের আকাশের তারার প্রেক্ষিতে মানুষের তৈরি আলো ঝিলমিল করতে লাগল। আমরা সরাসরি চন্দ্রাগিরি প্রেক্ষাগৃহে চলে গেলাম প্রথমেই। সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে প্রথম অনুষ্ঠানটির।
বিপুল উল্লাস ধ্বনিতে আমাদের আপ্যায়ন জানাল প্রায় ২০০০ মানুষ, যা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। তাঁদের আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে দিল। এই গভীর রাত পর্যন্ত এতটা সময় তাঁরা কী কষ্টেই না কাটিয়েছেন। এ এক অনন্য দেশ— এই ভারতবর্ষ। তার মানুষেরাও অন্য দেশের তুলনায়, অতুলনীয়। যখন কোনও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তাঁর সামনে, দেশের যে-কোনও অংশে যে-কোনও ভারতীয় অকল্পনীয় কিছু করে দেখাতে পারেন। ওয়্যানাডের এই ঘটনা তারই একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন মাত্র।
ওই অনুষ্ঠানে জেলায় শিক্ষা প্রসারের জন্য অরিভিদম প্রকল্পের উদ্বোধন করলাম। অরিভিদম-এর অর্থ জ্ঞান ও তথ্যের এক স্থান। জ্ঞান একজন ব্যক্তিকে মহান করে তোলে। সুতরাং, কেরালার জন্য উৎকৃষ্ট নাগরিকের বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প। আঞ্চলিক স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থায় ডিজিটাল জ্ঞানের যে অভাব রয়েছে তার অভাব মেটাতে ছাত্র, শিক্ষক এবং সাধারণের মধ্যে শিক্ষা, জ্ঞান ও তথ্যের প্রসার ঘটানো এই প্রকল্পর লক্ষ্য। প্রিন্সিপ্যাল, হেডমাস্টার ও আধিকারিকদের মধ্যে ভিডিও-সম্মেলনের ব্যবস্থা, প্রতি স্কুলে ওয়েবসাইট নির্মাণ, এবং সাধারণ মানুষের জন্য একটি নেটওয়ার্ক সৃষ্টি, এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত।
সাধারণের কাছে জ্ঞানের ভাণ্ডার পৌঁছিয়ে দিতে এক অপূর্ব হাতিয়ার হল তথ্যপ্রযুক্তি আর কম্পিউটারের সঙ্গে উদ্ভাবনী পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগের যুক্তকরণ। ফেসবুকের মতো অ্যাপ্লিকেশন আজ কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে । সেই প্রযুক্তি আর সেই দর্শন নিয়েই আমরা কেন গ্রামের মানুষের কাছে এনে দিতে পারব না জ্ঞান আর তথ্যের ভাণ্ডার?