তুয়েনসাং, নাগাল্যান্ড, অক্টোবর ২০০৭
২০০৭ সালের অক্টোবরে হিমালয়ের পূর্বপ্রান্তের শেষে অবস্থিত নাগাল্যান্ড ভ্রমণের কথা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। আয়তনে ক্ষুদ্র এই রাজ্য কিন্তু তার জীববৈচিত্র্য ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। তার জনসংখ্যা পঁচিশ লক্ষ যার বেশির ভাগই উপজাতি গোষ্ঠীর। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন উপজাতির রয়েছে বিবিধ উপভাষা এবং সংস্কৃতি। আমার অন্যতম ভ্রমণস্থান ছিল তুয়েনসাং। তুয়েনসাং সেখানকার সব থেকে বড় জেলা। ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় এর অবস্থানগত গুরুত্বও আছে। ওখানে থাকাকালীন ওই এলাকার উপজাতীয় পরিষদের একটি অধিবেশনে উপস্থিত হয়েছিলাম।
নাগাল্যান্ডের উপজাতি নেতারা সেখানকার রাজনৈতিক প্রতিনিধিই শুধু নন, তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতির রক্ষাকর্তাও বটে। তাঁরা প্রত্যেকেই হাজির হলেন তাঁদের রংবেরং-এর উজ্জ্বল ঐতিহ্যশালী পোশাকে। প্রত্যেকের হাতে এক গুচ্ছ কাগজ, তাতে হাতে লেখা তাঁদের আলোচ্য বিষয়গুলি। আমাকে জানানো হল যে, সাধারণত তাঁরা একটি বড় গাছের ছায়ায় বসে মিটিংটা করে থাকেন। কিন্তু যেহেতু ভারতের রাষ্ট্রপতি তাঁদের আজ অতিথি, তাই তাঁরা একটি বন্ধ ঘরে বসে মিটিংটা করতে রাজি হয়েছেন। তাঁরা আমাকে এবং পরে পরস্পরকে অভিনন্দন জানিয়ে অত্যন্ত পেশাদারি চলনে যে যাঁর জায়গায় গোল হয়ে বসে পড়লেন। অত্যন্ত গাম্ভীর্যময় পরিবেশে আলোচনা শুরু হল। সেদিনের আলোচ্যসূচিতে ছিল এই পরিষদের উদ্যোগে কেমনভাবে ফল ও সবজির চাষে উন্নতি এসেছে।
একজন বললেন, ‘এই প্রথম, চাহিদার থেকে অনেকগুণ বেশি ফলন হয়েছে।’
সকলে বাহবা জানালেন। আমারও ভাল লাগল ওখানকার গ্রামগুলির এই উজ্জ্বল সাফল্যে।
কিন্তু এক যুবক নেতা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শ্রদ্ধেয় সদস্যগণ, এটা সত্যিই আনন্দের যে, উৎপাদন ও মান দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কীভাবে একটি অর্থনৈতিকভাবে কার্যকরী মডেল তৈরি করতে পারি।’
কোনায় বসা এক মহিলা সদস্য তাঁর একটি ভাবনার কথা তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের এখন রপ্তানির বাজার খুঁজতে হবে।’ তিনি জানালেন, ‘আমার একটি গোষ্ঠী আছে যারা আশপাশের গ্রামের ও শহরের চাহিদা কেমন, তার একটা সমীক্ষা করতে পারবে। এইভাবেই আমাদের নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।’ উপস্থিত সকলেই তাঁকে সমর্থন করলেন।
এরপর এক বয়োজ্যেষ্ঠ উপজাতীয় নেতা তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। অন্যরা তা মন দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনতে লাগলেন। তিনি বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি মহোদয় এবং আমার পরিষদীয় সদস্যবৃন্দ, আমাদের একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হল, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বা শহরে যাবার ভাল রাস্তার বড় অভাব। পণ্য বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও যানের ব্যবস্থাও আমাদের নেই।’
এই সমস্যাটা নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক এক অতি আকর্ষক আলোচনা হল। নানান মতামতের আদানপ্রদানের পর স্থির হল যে, একটি সমবায় সমিতি গঠিত হবে। এই সমিতি অতিরিক্ত যে ফলন তা সদস্যদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে একটি শক্তপোক্ত পরিবহণ ব্যবস্থা তৈরি করে বিভিন্ন দুর্গম স্থানের দূরাবস্থিত বাজারে এমনকি নাগাল্যান্ডের সীমানার বাইরেও বিক্রির জন্য নিয়ে যাবে। এরপর, তাঁরা পর্যটন শিল্পে কীভাবে উন্নতি আনা যায়, তাই নিয়ে আলোচনা করলেন। এই আলোচনার ভিত্তিতে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর জন্য একটি স্মারকলিপি প্রস্তুত করলেন। মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হল, পর্যটকদের বিভিন্ন দর্শনযোগ্য স্থানে যাবার সুবিধার্থে কয়েকটি হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হোক। অতিরিক্ত কৃষিপণ্য পরিবহণেও সাহায্য প্রার্থনা করা হয়।
নিকোবর দ্বীপ, জানুয়ারি ২০০৫
অগম্যতা বহু ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের উপজাতি অঞ্চলে এ ঘটনা আমি দেখেছি। সেই ভয়ঙ্কর সুনামির পরের মাসে, ২০০৫-এর জানুয়ারিতে আমি নিকোবর দ্বীপে কিছু উপজাতি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করি। আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করি, কেন তাঁরা সমুদ্রসম্পদকে তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কাজে লাগাচ্ছেন না।
আমি তাঁদের বলি, ‘এত সমুদ্রসম্পদ আপনাদের কাছে রয়েছে। প্রতিবেশী দেশের মত্স্যজীবীরা আমাদের সাগরের সম্পদ বেআইনিভাবে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আপনারা কেন এই জাতীয়সম্পদ নিজেরা ব্যবহার করছেন না?’
উপজাতি নেতারা কিছুটা ভেবে আমার কথার উত্তর দিলেন। তাঁদের সমবেত বক্তব্য ছিল যে, তাঁরা চিরাচরিত প্রথায় মাছ শিকার করতে জানেন। কিন্তু অতিরিক্ত মাছ কীভাবে তাঁদের নিজ নিজ গ্রামের বাইরের বাজারে নিয়ে গিয়ে বেচতে হবে, তার ধারণা নেই। মত্স্য প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তি বিষয়েও তাঁরা জানতে ইচ্ছুক। এই অজ্ঞানতাই তাঁদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
নিকোবর যাবার আগে নয়া দিল্লিতে আমাকে জানানো হয়েছিল যে, সুনামি বহু পিতামাতাকে কেড়ে নিয়ে তাঁদের সন্তানদের অনাথ করে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম সেই দ্বীপে কোনও অনাথ আশ্রমই নেই। আমি নেতাদের বললাম, ‘আন্দামানে গিয়ে আমি তিনটি অনাথ আশ্রম দেখেছি। নিকোবরে কোথায়?’
আমাকে বিস্মিত করে তাঁরা আমাকে জানালেন, ‘এখানে কোনও অনাথ আশ্রম নেই।’ এ যেন সুনামির পর কালো মেঘের কোলে রৌপ্যঝলক। এক বরিষ্ঠ অথচ কর্মঠ নেতা অনেক ভেবে আমায় বললেন, ‘যে সব ছেলেমেয়েদের পিতামাতা নেই তারা আমাদের ঘরের ছেলেমেয়ে হয়ে রয়েছে। আমাদের এখানে তাই অনাথ আশ্রমের প্রয়োজন নেই। আমাদের ঘরই তাদের ঘর। আসলে এই দ্বীপে আমরা একটি বৃহৎ পরিবার।’