.
যখন আমি সেন্ট জোসেফ’স-এ বি.এসসি. ডিগ্রি কোর্সে যোগ দেই, তখনও আমি উচ্চ শিক্ষার অন্য আর কোনো সুযোগ সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না। বিজ্ঞানের একজন ছাত্রের জন্য সহজলভ্য চাকরির সুযোগ সম্পর্কেও আমার কোনো তথ্য জানা ছিল না। একটা বি.এসসি. ডিগ্রি অর্জনের পরই কেবল আমি উপলব্ধি করি যে পদার্থবিদ্যা আমার বিষয় নয়। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে। অনেক আগেই আমি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যোগ দিতে পারতাম, ঠিক আমার ইন্টারমিডিয়েট কোর্স শেষ করার পর পরই। কখনও না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়াও ভালো, এই কথা আমি নিজেকে বললাম মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) ভর্তির আবেদন জমা দিয়ে। সেই সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল সমগ্র দক্ষিণ ভারতে কারিগরি শিক্ষার মনিরত্ন।
নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকায় আমার নাম উঠল, কিন্তু এই মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারটা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। প্রায় এক হাজার রূপি প্রয়োজন, কিন্তু আমার বাবার পক্ষে অত টাকা জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। সেই সময় আমার বোন জোহরা আমার পাশে দাঁড়াল, নিজের সোনার বালা ও চেইন বন্ধক রেখে আমাকে সে টাকা জোগাড় করে দিল। আমার সামথ্যের প্রতি তার এই বিশ্বাস আর আমাকে শিক্ষিত মানুষ হিসাবে দেখতে চাওয়ার তার এই দৃঢ়তা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করল। নিজের উপার্জিত অর্থে বন্ধকি থেকে তার বালা ছাড়িয়ে আনার শপথ নিলাম আমি। সময়ের ওই পর্যায়ে টাকা উপার্জনের যে একটা মাত্র উপায় আমার সামনে ছিল তা হলো কঠিনভাবে পড়াশোনা করে একটা বৃত্তি অর্জন করা। আমি পুরো দমে সামনে এগিয়ে চললাম।
এমআইটিতে আমাকে সবচেয়ে বেশি মোহাবিষ্ট করেছিল দুটো অব্যবহৃত বিমান পোত। ফ্লাইং মেশিনের নানারকম সাবসিস্টেম প্রদর্শনের জন্য ও দুটো রাখা হয়েছিল। ওগুলোর প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করতাম আমি, আর অন্য শিক্ষার্থীরা হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার পরও দীর্ঘ সময় ওগুলোর নিকটে বসে থাকতাম, আকাশে মুক্তভাবে ওডার, পাখির মতো, মানুষের ইচ্ছায় মুগ্ধ। আমার প্রথম বর্ষ সম্পূর্ণ করার পর, যখন একটা বিশেষ শাখা বেছে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, আমি তাৎক্ষণিকভাবে নিজের জন্য পছন্দ করলাম অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এত দিনে লক্ষ্যটা আমার মনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল: আমি বিমান ওড়াতে চলেছি। এ ব্যাপারে আমি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলাম, আমার জেদের অভাব সত্ত্বেও, যা সম্ভবত এসেছিল আমার দারিদ্রের পটভূমি থেকে। এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমি বিশেষ চেষ্টা করি। এতে হতাশা ছিল, কিন্তু আমার বাবার উৎসাহব্যাঞ্জক কথা আমাকে স্থির রেখেছিল। যে অন্যদের জানে সে শিক্ষিত, কিন্তু জ্ঞানী হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে জানে। জ্ঞান ছাড়া শিক্ষা কোনো কাজে আসে না।
এমআইটিতে আমার কোর্সে তিনজন শিক্ষক আমার ভাবনাকে আকৃতি দিয়েছিলেন। তাদের সমন্বিত অবদান ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল যার ওপর পরে আমি আমার পেশাগত ক্যারিয়ার নির্মাণ করি। এই তিনজন শিক্ষক হলেন অধ্যাপক স্পন্ডার, অধ্যাপক কেএভি পান্ডালাই ও অধ্যাপক নরসিংহ রাও। তাদের প্রত্যেকেরই ছিল অত্যন্ত উঁচু ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাদের সবারই একটা বিষয় ছিল অভিন্ন ছাত্রদের মেধার ক্ষুধা মেটানোর সামর্থ্য।
.
অধ্যাপক স্পন্ডার আমাকে পড়াতেন টেকনিক্যাল অ্যারোডাইনামিক্স। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সমৃদ্ধ বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন অস্ট্রিয়ান ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে নাৎসিদের হাতে তিনি বন্দি হয়েছিলেন এবং একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আটক থাকেন। বোধগম্য কারণেই জার্মানদের প্রতি তার মধ্যে বিরাগ সৃষ্টি হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, অ্যারোনটিক্যাল বিভাগের প্রধান ছিলেন একজন জার্মান, অধ্যাপক ওয়াল্টার রেপেনথিন। আরেকজন সুপরিচিত অধ্যাপক, ড. কুর্ট ট্যাংক, ছিলেন খ্যাতিমান অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার যিনি এক আসনবিশিষ্ট জার্মান ফাইটার বিমান Focke=Wulf Fw 190)-এর নকশা তৈরি করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেটি ছিল অনন্যসাধারণ জঙ্গি বিমান। ড. ট্যাংক পরে ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (এইচএএল)-এ যোগ দেন এবং ভারতের প্রথম জেট ফাইটার HF-24 Marut-এর নকশার দায়িত্ব পান।
এ অবস্থার মধ্যেও অধ্যাপক স্পন্ডার নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র রক্ষা করে চলেন। এবং উঁচু পেশাগত মান বজায় রাখেন। তিনি সবসময় ছিলেন শান্ত, উদ্যমী আর সম্পূর্ণ আত্ম-নিয়ন্ত্রিত। তিনি সর্বসাম্প্রতিক প্রযুক্তির সঙ্গে সংযোগ রেখে চলতেন এবং চাইতেন তার ছাত্ররাও তাই করুক। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হওয়ার আগে আমি তার পরামর্শ নিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, নিজের ভবিষ্যৎ আশা নিয়ে কারো উদ্বিগ্ন হওয়া উচিৎ নয় কখনও। তার চেয়ে বরং পর্যাপ্ত ভিত্তি স্থাপন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যাপক স্পন্ডার লক্ষ করতেন যে, শিক্ষা সুযোগ বা শিল্প অবকাঠামোর অভাব ভারতীয়দের কোনো সমস্যা নয়, তাদের সমস্যা ছিল শৃঙ্খলা ও তাদের পছন্দকে যুক্তিবাদী করে তোলার মধ্যে। পার্থক্য করতে না পারার ব্যর্থতা। অ্যারোনটিকস কেন? ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নয় কেন? কেন নয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং? সকল ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীকে আমি নিজে বলব যে, যখন তারা নিজেদের বিশেষ ক্ষেত্রে পছন্দ করবে, তখন অপরিহার্য ভাবে বিবেচনা করতে হবে যে ওই পছন্দ তাদের ভেতরকার অনুভূতি ও উচ্চাকাঙ্খ প্রকাশ করছে কিনা।