সেন্ট জোসেফ’স-এ রেভারেন্ড ফাদার টিএন সেকুয়েইরার মতো একজন। শিক্ষককে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন, তাছাড়াও ছিলেন আমাদের হোস্টেল ওয়ার্ডেন। তিনতলা হোস্টেল ভবনে আমরা প্রায় একশ শিক্ষার্থী বসবাস করতাম। রেডারেন্ড ফাদার হাতে একটা বাইবেল নিয়ে প্রতি রাতে প্রত্যেকটি ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তার শক্তি ও ধৈর্য ছিল বিস্ময়কর। ছেলেদের প্রতিটা মুহূর্তের যত্ন নিতেন তিনি পরম কর্তব্যপরায়ণতার। সঙ্গে। দীপাবলীতে, তার নির্দেশে, হোস্টেলের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্রাদার ও উৎসবের। স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিটা কক্ষে গিয়ে ধর্মীয় স্নানের জন্য চমৎকার গিঙ্গেলি তেল বিতরণ করত।
সেন্ট জোসেফ’স ক্যাম্পাসে আমি চার বছর ছিলাম। আমার কামরায় আমি ছাড়া আরও দুজন থাকত। একজন ছিল শ্রীরঙ্গমের এক গোঁড়া আয়েঙ্গার আর অন্যজন কেরালার এক সিরিয়ান খৃস্টান। আমরা তিনজন একসঙ্গে দারুণ একটা সময়। কাটিয়েছিলাম। হোস্টেলে আমার তৃতীয় বর্ষ চলাকালে আমাকে নিরামিষ মেসের সচিব বানানো হলে আমরা রোববারের মধ্যাহ্নভোজে রেক্টর রেভারেন্ড ফাদার কালাথিলকে আমন্ত্রণ জানাই। আমাদের মেনুতে ছিল নানা রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার। ফলাফল ছিল অপ্রত্যাশিত, তবে রেভারেন্ড ফাদার আমাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি। রেভারেন্ড ফাদার কালাখিলের সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্ত আমরা উপভোগ করেছিলাম, তিনি শিশুসুলভ উফুল্লতা নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন আমাদের চপল কথাবার্তায়। আমাদের সবার জন্য সেটা ছিল এক স্মরণীয় ঘটনা।
সেন্ট জোসেফ’স-এ আমার শিক্ষকরা ছিলেন কাঞ্চি পরমাচার্যের খাঁটি অনুগামী। পরমাচার্য দান ক্রিয়া উপভোগ করতে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করতেন। ক্যাম্পাসে এক সঙ্গে হেঁটে বেড়ানো আমাদের গণিত শিক্ষক অধ্যাপক থোথাথ্রি আয়েঙ্গার ও অধ্যাপক সূর্যনারায়ণ শাস্ত্রীর বর্ণিল সুতি আজও আমার মনে প্রেরণা জোগায়।
সেন্ট জোসেফ’স-এ আমি যখন শেষ বর্ষে তখন ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ জন্মে। আমি মহান ধ্রুপদী সাহিত্যিকদের রচনা পড়তে শুরু করি, তলস্তয়, স্কুট ও হার্ডি ছিল আমার বিশেষ রকমের প্রিয়, তারপর আমি দর্শন বিষয়ক রচনাগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হই। ঠিক এই সময়টাতেই পদার্থবিদ্যার প্রতি সৃষ্টি হয় আমার বিপুল আগ্রহ।
সেন্ট জোসেফ’স-এ পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক চিন্না ডুরাই ও অধ্যাপক কৃষ্ণমূর্তি সাবঅ্যাটোমিক ফিজিক্স বিষয়ে পাঠ দিতেন। তার ফলে বস্তুর রেডিও অ্যাকটিভ ক্ষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় ও হাফ-লাইফ পিরিয়ডের ধারণার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। রামেশ্বরমে আমার বিজ্ঞান শিক্ষক শিবসুব্রামানিয়া আয়ার আমাকে কখনও শেখাননি যে অধিকাংশ সাবঅ্যাটোমিক বস্তু অস্থির এবং অন্য বস্তুর মধ্যে নির্দিষ্ট একটা সময়ের পর সেগুলো বিভাজিত হয়ে যায়। এসব বিষয় আমি জানতে পারছিলাম প্রথমবারের মতো। কিন্তু যখন তিনি আমাকে অধ্যবসায়ের সঙ্গে কঠোরভাবে চেষ্টা করার শিক্ষা দিয়েছিলেন, যেহেতু সকল যৌগিক বস্তুতে ক্ষয় হচ্ছে সহজাত ব্যাপার, তখন কি আসলে তিনি একই বিষয়ে কথা বলছিলেন না? আমি ভাবি, কেন কিছু মানুষ মনে করে বিজ্ঞান মানুষকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় খোদার কাছ থেকে? আমি এটাকে যেভাবে দেখি তা হলো-বিজ্ঞানের পথ সর্বদা হৃদয়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। আমার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান হচ্ছে আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি ও আত্ম-উপলব্ধির পথ।
.
এমনকি বিজ্ঞানের যুক্তিবাদী চিন্তাধারাও রূপকথার বাসা হতে পারে। আমি সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক বইয়ের আগ্রহী পাঠক এবং মহাকাশের বস্তু সম্পর্কে পড়তে আনন্দ পাই। আমাকে স্পেস ফ্লাইটের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন প্রশ্ন করার সময় অনেক বন্ধু কখনও কখনও জ্যোতিষি বিদ্যার মধ্যে ঢুকে পড়েন। সততার সঙ্গে বললে বলতে হয়, আমাদের সৌরজগতে অবস্থিত দূরবর্তী গ্রহসমূহের প্রতি লোকদের বিপুল গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে তা আমি সত্যি কখনও বুঝতে পারিনি। শিল্প হিসাবে জ্যোতিষিবিদ্যার বিরুদ্ধে বলার আমার কিছুই নেই, কিন্তু বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে তাকে গ্রহণযোগ্য করতে চাইলে তা আমি বাতিল করে দেব। আমি জানি গ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জ এবং এমনকি উপগ্রহ সম্পর্কেও এইসব মিথ কীভাবে উদ্ভূত হয়েছিল। আর সেই মিথ অনুযায়ী লোকেরা বিশ্বাস করে যে এইসব বস্তু মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। আমি যেমনটা মনে করি, পৃথিবী হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিমান ও ক্ষমতাশালী গ্রহ। জন মিলটন এ বিষয়টা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার Paradise Lost কবিতায়:
…What if the Sun
Be center to the World, and other stars…
The planet earth, so steadfast though she seem,
In sensibly three different motions move?
এই গ্রহের যেখানেই তুমি যাও সেখানেই তুমি দেখতে পাবে গতি আর জীবন। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে অনড় বস্তু যেমন পাথর, ধাতু, কাঠ, মাটি ইত্যাদি সবকিছুই গতিময়তায় পূর্ণ, কারণ এসবের প্রতিটা নিউক্লিয়াসকে ঘিরে অবিরাম নেচে চলেছে ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াসের দ্বারা সেগুলোর ওপর আরোপিত অবরোধের প্রতি সাড়া দিতে এই গতি উৎপন্ন হয়, বৈদ্যুতিক শক্তির দ্বারা যা চেষ্টা করে যতদূর সম্ভব সেগুলোকে কাছাকাছি ধরে রাখতে। নির্দিষ্ট পরিমান শক্তি সম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তি মানুষের মতোই ইলেকট্রনও অবরোধ পছন্দ করে না। নিউক্লিয়াস যত শক্ত করে ইলেকট্রনকে ধরে রাখবে, ইলেকট্রনের ঘূর্ণনবেগও তত বেশি হবে? বস্তুত একটি অণুতে ইলেকট্রনের আটক অবস্থার ফলাফল থেকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার ঘুর্ণন গতির সৃষ্টি হতে পারে! এই উঁচু বেগমাত্রার কারণে এটমকে অনমনীয় অবস্থার মতো মনে হয়, ঠিক যেমন অতিদ্রুতগতিতে ঘূর্ণায়মান ফ্যানকে একটা চাকতির মতো মনে হয়। আরও জোরালোভাবে এটমের ওপর চাপ প্রয়োগ করা খুবই অসুবিধাজনক-এভাবে বস্তুসমূহ পরিচিত কঠিন অবয়ব পেয়ে থাকে। প্রতিটা কঠিন বস্তু, এভাবে, নিজের মধ্যে প্রচুর খালি জায়গা ধারণ করে এবং অনড় সমস্ত কিছু নিজের মধ্যে ধারণ করে বিপুল গতি। ব্যাপারটা এমন যেন আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটা মূহূর্তে পৃথিবীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শিবের নাচ।