ইতিবাচক চিন্তাশক্তি সম্পর্কে জালালুদ্দিন আমার সঙ্গে কথা বলত এবং আমি প্রায়ই গৃহকাতরতা অথবা বিষণ্ণতা অনুভব করলে তার সেই কথাগুলো স্মরণ করতাম। যেমনটা সে বলেছিল তা করার জন্য আমি কঠিন চেষ্টা করতাম, তাতে আমার চিন্তা ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম, এবং তাতে আমার লক্ষ্যের ওপর প্রভাব পড়ত। ভাগ্যের ব্যাপার হলো, সেই লক্ষ্য আমাকে রামেশ্বরমে ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি, বরং আমাকে আরও অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমার শৈশবের বাড়ি থেকে।
.
২.
রামনাথপুরমে শোয়ার্টজ হাই স্কুলে আমি একটু গুছিয়ে নেবার পর আমার ভেতরের পনেরো-বছর-বয়স্ক মানুষটা আবার জেগে উঠল। আমার শিক্ষক, ইয়াজুরাই সলোমন, ছিলেন তরুণ মনের জন্য এক আদর্শ গাইড, যে মন তখনও জানে না তার সামনে কী রকম সম্ভাবনা আর বিকল্প ধারা পড়ে আছে। নিজের উষ্ণ ও খোলামেলা মনোভা দিয়ে ক্লাসে তিনি তার ছাত্রদের মনে স্বস্তি জাগিয়ে তুলতেন। তিনি বলতেন যে একজন খারাপ ছাত্র একজন দক্ষ শিক্ষকের কাছ থেকে যা শিখতে পারে তার চেয়ে একজন ভালো ছাত্র একজন খারাপ শিক্ষকের কাছ থেকে অনেক বেশি শিখতে পারে।
রামনাথপুরমে আমার অবস্থানকালে তার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল তা ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার সাহচর্যে আমি শিখেছিলাম যে, যে-কোনো ব্যক্তি তার নিজের জীবনের ঘটনাবলীর ওপর বিপুল প্রভাব খাটানোর অনুশীলন আয়ত্ব করতে পারে। ইয়াড়রাই সলোমন বলতেন, জীবনে সফল হতে হলে আর ফলাফল অর্জন করতে হলে, তোমাকে অবশ্যই তিনটে প্রবল শক্তি সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে আর সেগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে-আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস, আর প্রত্যাশা।
ইয়াড়রাই সলোমন, পরবর্তীকালে যিনি হয়েছিলেন একজন রেভারেন্ড, আমাকে শিখিয়েছিলেন যে কোনো কিছু ঘটুক বলে আমি যা চাই তার আগে আমাকে তা কামনা করতে হবে এবং আমাকে পূর্ণ নিশ্চিত থাকতে হবে যে তা ঘটবে। আমার নিজের জীবন থেকেই একটা উদাহরণ টানা যেতে পারে। একেবারে শৈশবকালে আমি মোহাবিষ্ট হতাম আকাশের রহস্যময়তায় ও পাখিদের উড্ডয়নে। আমি সারস ও সীগালের উড্ডয়ন লক্ষ্য করতাম আর ওড়ার জন্য আকুল হতাম। যদিও মফঃস্বলের বালক ছিলাম, তবুও আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে এক দিন আমিও আকাশে ভাসব। প্রকৃত পক্ষে আমি ছিলাম রামেশ্বরমের প্রথম শিশু যে আকাশে উড়েছিল।
ইয়াড়রাই সলোমন ছিলেন এক মহান শিক্ষক, কারণ সমস্ত বাচ্চাদের মধ্যে তাদের নিজেদের মূল্য সম্পর্কে একটা বোধ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সলোমন আমার আত্মশক্তি উঁচুতে তুলে দিয়েছিলেন আর আমাকে প্রভাবিত করেছিলেন, আমি তো ছিলাম সেই মা-বাবার সন্তান শিক্ষার সুবিধা থেকে যারা বঞ্চিত হয়েছিলেন, তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে যা ইচ্ছা করি তা হবার সামর্থ্য আমার আছে। মনে বিশ্বাস থাকলে, তোমার ভাগ্য তুমি পরিবর্তন করতে পারবে, তিনি বলতেন।
একদিন, আমি তখন ফোর্থ ফর্মে পড়ি, আমার গণিত শিক্ষক রামকৃষ্ণ আয়ার অন্য এক ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন। অন্যমনস্কতার কারণে আমি ওই শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ি আর পুরাতন প্রথা অনুযায়ী রামকৃষ্ণ আয়ার আমার ঘাড় চেপে ধরেন আর পুরো ক্লাসের সামনে আমাকে বেত মারেন। বেশ কয়েক মাস পর, যখন গণিতে আমি ফুল মার্ক পেয়েছি, সকালের অ্যাসেম্বলিতে গোটা স্কুলের সামনে ঘটনাটা বর্ণনা করে তিনি ব্যাখ্যা দিলেন। যাকেই আমি বেত মারি সেই মহান ব্যক্তিতে পরিণত হয়। আমার কথাটা মনে রেখ তোমরা, এই ছেলেটা তার স্কুল ও শিক্ষকদের জন্য গৌরব বয়ে আনবে। আগের যন্ত্রণা উপশম হয়েছিল তার এই প্রশংসায়!
শোয়ার্টজ-এ আমার লেখাপড়া যখন সম্পূর্ণ হলো, তখন আমি নিজের সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত আত্মবিশ্বাসী এক বালক। আরও পড়াশোনা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে এক সেকেন্ডও ভাবতে হয়নি। সেই সব দিনে আমাদের কাছে। পেশাগত শিক্ষার সম্ভাবনা বলতে কিছু ছিল না; উচ্চ শিক্ষা বলতে বোঝাত কলেজে পড়া। সবচেয়ে কাছের কলেজটি ছিল তিরুচ্চিরাঞ্চলিতে, সেকালে লেখা হতো ত্রিচিনোপলি, এবং সংক্ষেপে ত্রিচি।
.
১৯৫০ সালে আমি উপস্থিত হলাম ত্রিচির সেন্ট জোসেফ’স কলেজে, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে। পরীক্ষার গ্রেড অনুযায়ী আমি খুব একটা মেধাবী ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু রামেশ্বরমে আমার দুই বন্ধুকে ধন্যবাদ, আমি এক রকম ধৈর্যগুণ অর্জন করেছিলাম বাস্তবিক অর্থেই।
শোয়ার্টজ থেকে যখনই আমি রামেশ্বরমে ফিরে যেতাম, আমার বড়ো ভাই মুস্তাফা কামাল তখনই আমাকে তার কাজে একটু সাহায্য করার জন্য ডেকে নিত, রেলওয়ে স্টেশন রোডে একটা মুদি দোকান চালাত সে, আর আমার দায়িত্বে দোকান ছেড়ে দিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্য উধাও হয়ে যেত। আমি বিক্রি করতাম তেল, পেঁয়াজ, চাল এবং অন্যান্য দ্রব্য। আমি আবিষ্কার করলাম সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেশি বিক্রি হয়ে যায় সিগারেট ও বিড়ি। অবাক হয়ে ভাবতাম, গরীব মানুষেরা তাদের কঠোর পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ এভাবে বোয়া গিলে উড়িয়ে দেয় কেন। মুস্তাফাঁকে সাহায্য করতে না হলে আমার ছোটোভাই কাশিম মোহাম্মদের কিওস্কে বসতাম আমি। সেখানে বিক্রি করতাম সমুদ্র শঙ্খ দিয়ে তৈরি নানা প্রকার সৌখিন দ্রব্য।