মিত্রবাহিনী এগিয়ে ছিল প্রযুক্তির সর্বসাম্প্রতিক ব্যবহারের দিক দিয়ে। তাদের কৌশলগত অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হয়েছিল আশি ও নব্বই দশকের প্রযুক্তি অনুযায়ী। কিন্তু ইরাকের কাছে যেসব অস্ত্র ছিল সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল ষাট ও সত্তুর দশকের প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
এখন বলতেই হয়, আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে আধিপত্য অর্জন। চীনা যুদ্ধ বিষয়ক দার্শনিক সান জু ২০০০ বছর আগে বলে গেছেন, যুদ্ধে আসল বিষয় হচ্ছে শত্রুকে শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবে পরাস্ত করা, তার মনে পরাজয়ের বোধ ঢুকিয়ে দিতে পারলেই সে ভেঙে পড়বে, তার পতন ঘটবে, আসল কাজ হলো তার ইচ্ছাশক্তিকে ভেঙে দেওয়া। আজকের দিনে মনে হয় দার্শনিক সান বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধ কৌশলে প্রযুক্তির আধিপত্য কল্পনা করতে পেরেছিলেন। উপসাগরীয় যুদ্ধে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের সঙ্গে মিসাইল ফোর্স মিলিত হয়ে যে অবস্থাটা তৈরি করেছিল, সেটা মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিক এক্সপার্টদের জন্য ছিল এক মহাভোজ। এ ক্ষেত্রে মিসাইল, ইলেকট্রনিক ও ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার নিয়েছিল প্রধান ভূমিকা। এটা ছিল একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধ-নাটকের পর্দা উত্তোলন।
ভারতে, এমনকি আজকের দিনেও, অধিকাংশ মানুষ প্রযুক্তি বলতে বোঝে বোয়াচ্ছন্ন ইস্পাত কারখানা অথবা ঘড়ঘড়ে যন্ত্রপাতি। প্রযুক্তির এ এক অপর্যাপ্ত ধারণা। মধ্যযুগে হর্স কলার উদ্ভাবন বিশাল পরিবর্তন এনেছিল কৃষি পদ্ধতিতে। এর কয়েক শতাব্দি পর উদ্ভাবিত বেসমার ফার্নেরস প্রযুক্তির দিকে ছিল আরেক অগ্রগতি। আসলে কৌশল আর যন্ত্র মিলে তৈরি হয় প্রযুক্তি। আর এর ব্যবহার চলে সর্বক্ষেত্রে কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন তৈরিতে, মৎস্য উৎপাদনে, আগাছা উপড়ে ফেলতে, থিয়েটারে আলো জ্বালাতে, রোগীদের চিকিৎসা করতে, ইতিহাস শেখাতে, যুদ্ধে লড়াই করতে, এমনকি যুদ্ধ প্রতিরোধ করতেও।
উপসাগরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল মিত্রবাহিনীর প্রযুক্তিগত আধিপত্যের ভেতর দিয়ে। এরপর ডিআরডিএল এবং আরসিআইয়ের ৫০০ বিজ্ঞানী একত্রিত হলেন। নতুনভাবে উত্থিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে। আমি একটা প্রশ্ন রাখলাম ও অন্যান্য দেশের টেকনোলজি ও অস্ত্রশস্ত্র কি কার্যকর? আর যদি তাই হয়, তাহলে কি .. আমাদেরও সে সবের উদ্যোগ নেওয়া দরকার? আলোচনায় আরও অনেক গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। যেমন কার্যকর ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সাপোর্ট কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়? এলসির মতো সমানভাবে প্রয়োজনীয় সিস্টেমের সঙ্গে একই সময়ে কীভাবে মিসাইল উন্নয়ন কার্যক্রম চালান যাবে? আর অগ্রগতির জন্য প্রধান জায়গাগুলো কোথায়?
তিন ঘন্টার প্রাণবন্ত আলোচনা শেষে বিজ্ঞানীরা শপথ নিলেন বেশ কয়েকটি বিষয়ে। যেমন-পৃথ্বীর ডেলিভারি আরও নিখুঁত করে তুলতে সিইপি কমিয়ে আনা হবে, ত্রিশূল-এর গাইডেন্স আরও নিখুঁত করা হবে এবং বছরের শেষ নাগাদ অগ্নির সমস্ত কার্বন-কার্বন রি-এন্ট্রি কন্ট্রোল সারফেস তৈরি করা হবে। পরবর্তী সময়ে এসব শপথ পূরণ করা হয়েছিল। এ বছরেই নাগ পরীক্ষা করা হলো ভূগর্ভে। ত্রিশূল ছোঁড়ার পর সেটা সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র সাত মিটার ওপর দিয়ে ভেসে চলল, শব্দের গতির চেয়েও তিনগুণ বেশি গতিতে। এই পরীক্ষাটি ছিল একটা ব্রেকথ্র। দেশীয় শিপ-লঞ্চ অ্যান্টি সি-স্কিমার ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
একই বছর বোম্বাইয়ের আইআইটি আমাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করল। এ উপলক্ষে অধ্যাপক বি নাগ আমার সম্পর্কে বর্ণনা করলেন যে, আমি একটা নিখাদ প্রযুক্তিগত ভিত্তি সৃষ্টির পেছনে এক অনুপ্রেরণা, যেখান থেকে ভারতের ভবিষ্যৎ মহাকাশ কর্মসূচি একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে। হয়তো অধ্যাপক নাগ কেবল ভদ্রতা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি যে ভারত আগামী শতাব্দীতে নিজের স্যাটেলাইট স্থাপন করতে পারবে। মহাকাশের ৩৬০০০ কিলোমিটার দূরে এবং নিজেরই লঞ্চ ভেহিকল-এর সাহায্যে। তাছাড়া মিসাইল পাওয়ারেও পরিণত হবে ভারত। আমাদের দেশ বিপুল প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
১৫ অক্টোবর আমার বয়স হলো ষাট বছর। আমি অবসরে যাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর কম সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুদের জন্য একটা স্কুল খোলার পরিকল্পনা করেছিলাম। আমার বন্ধু অধ্যাপক পি রামা রাও, যিনি ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পরিচালনা করছিলেন, আমার সঙ্গে মিলে স্কুলটা দেওয়ার জন্য লেগে গেলেন আর সেটার নামও ঠিক করে ফেললেনঃ রাও-কালাম স্কুল। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা আমরা বাস্তবে রূপ দিতে পারলাম না। কারণ ভারত সরকার আমাদের কাউকেই নিজ নিজ পদ থেকে অবসর দিল না।
এই সময়েই আমার স্মৃতিকথা, পর্যবেক্ষণ আর নির্দিষ্ট বিষয়ে অভিমত লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ভারতীয় তরুণদের সবচেয়ে বড়ো যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তা হলো, স্বচ্ছ ভবিষ্যৎ দর্শনের অভাব, নির্দেশনার অভাব। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই, আজকের এই আমাকে যারা গড়ে তুলেছিলেন তাদের কথা আর যে সব পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আমি বড়ো হয়ে উঠেছিলাম সে সব কথা আমি লিখব। এর উদ্দেশ্য শুধু এই নয় যে কয়েকজন ব্যক্তির প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করব, কিংবা আমার জীবনের নির্দিষ্ট কিছু চিত্র তুলে ধরব বিশেষভাবে। আমি আসলে যা বলতে চেয়েছি তা হলো, জীবন সম্পর্কে কোনো মানুষেরই, সে যত দুরাবস্থায় থাকুক, কিংবা সুবিধাপ্রাপ্তহীন বা ক্ষুদ্র, কখনই হতাশ হওয়া উচিৎ নয়। সমস্যা হচ্ছে জীবনেরই একটা অংশ। ভোগান্তি হচ্ছে সাফল্যের সৌরভ। যেমন একজন বলেছেন: