প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা সমাবর্তন দিবস হচ্ছে শক্তির ফ্লাডগেট খুলে দেবার মতো ব্যাপার যা, প্রতিষ্ঠান সংস্থা ও শিল্পকারখানায় সজ্জিত হলে, জাতিগঠনে সহযোগিতা করে, আমি তরুণ গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে বললাম। আমি অনুভব করলাম, কোনো দিক থেকে আমি রেভারেন্ড সলোমনের কথারই প্রতিধ্বনি করছি, যা তিনি বলেছিলেন প্রায় অর্ধ-শতাব্দী আগে। বক্তৃতা শেষ হলে আমি মাথা নুইয়ে সম্মান জানালাম আমার শিক্ষককে। মহান স্বপ্নদ্রষ্টাদের বিশাল স্বপ্ন হয় সর্বদা সীমা অতিক্রান্ত, আমি রেভারেন্ড সলোমনকে বললাম। তুমি যে শুধু আমার লক্ষ্যেই পৌঁছেছ তাই নয়, কালাম! তুমি ওগুলোর দীপ্তিকেও ছাড়িয়ে গেছ, তিনি আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসা গলায় আমাকে বললেন।
পরের মাসে আমি ত্রিচিতে গেলাম আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগালাম সেন্ট জোসেফ কলেজ পরিদর্শনে। সেখানে রেভারেন্ড ফাদার সেকুয়েইরা, রেভারেন্ড ফাদার এরহার্ট, অধ্যাপক হোথাথরি আয়েঙ্গারকে খুঁজে পেলাম না। কিন্তু আমার মনে হলো সেন্ট জোসেফ-এর প্রতিটা পাথরে তখনও যেন ওইসব মহান মানুষের জ্ঞানের ছাপ লেগে ছিল। সেন্ট জোসেফ-এ আমার স্মৃতির দিনগুলোর কথা আমি তরুণ ছাত্রদের কাছে বর্ণনা করলাম আর আমাকে যারা গড়ে তুলেছিলেন সেই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম।
আকাশ-এর টেস্ট ফায়ারিং দিয়ে আমরা উদযাপন করলাম জাতির চুয়াল্লিশতম স্বাধীনতা দিবস। প্রহ্লাদ ও তার দল কম্পোজিট মোডিফাইড ডাবল বেজ প্রোপেল্যান্টের ভিত্তিতে নতুন একটা সলিড প্রোপেল্যান্ট বুস্টার সিস্টেম তৈরি করেছিল। নজিরবিহীন উচ্চ শক্তিসম্পন্ন এই প্রোপেল্যান্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল দূরপাল্লার সারফেস-টু-এয়ার মিসাইলের নিশ্চয়তা বিধানে। আঘাতযোগ্য ক্ষেত্রে ভূমিভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষায় একটা জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছিল দেশ।
১৯৯০ সালের শেষ দিকে, বিশেষ এক সমাবর্তনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ডক্টর অব সায়েন্স উপাধিতে সম্মানিত করল। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষের সঙ্গে একই তালিকায় আমার নাম দেখে আমি কিছুটা হতবুদ্ধি হয়েছিলাম। একই সমাবর্তনে তাকেও সম্মানিত করা হয়। ম্যান্ডেলার মতো এক কিংবদন্তির সঙ্গে সাধারণ মিল আমার কী ছিল? হয়তো সেটা ছিল আমাদের মিশনে আমাদের নাছোড়বান্দা মনোভাব। আমার দেশে আমার অ্যাডভান্সিং রকেট বিজ্ঞানের মিশন ম্যান্ডেলার মিশনের সঙ্গে তুলনা করলে কিছুই ছিল না। কারণ ম্যান্ডেলার মিশন ছিল বিপুল গণমানবতার জন্য মর্যাদা অর্জনের মিশন। কিন্তু আমাদের আকাঙ্ক্ষার ব্যাকুলতার মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না। দ্রুত কিন্তু কৃত্রিম আনন্দের পেছনে ছুটে বরং নিখাদ সাফল্য অর্জনের জন্য আরও বেশি নিবেদিত প্রাণ হও, তরুণ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আমার এই ছিল পরামর্শ।
মিসাইল কাউন্সিল ১৯৯১ সালকে ডিআরডিএল এবং আরসিআইয়ের জন্য প্রবর্তনার বছর হিসাবে ঘোষণা করল। আইজিএমডিপিতে আমরা যখন একটা ধারাবাহিক ইঞ্জিনিয়ারিং রুট পছন্দ করেছিলাম, তখন আমরা একটা রাফট্র্যাক নির্বাচন করেছিলাম। পৃথ্বী ও ত্রিশূল-এর উন্নয়নমূলক পরীক্ষা সম্পাদনের পর, আমাদের পছন্দ এখন গড়িয়েছে পরীক্ষার ওপর। এক বছরের মধ্যে ইউজার ট্রায়ালের জন্য আমার সহকর্মীদের আমি উদ্দীপ্ত করলাম। আমি জানতাম যে এটা কঠিন কাজ হবে। কিন্তু সেটা আমাদের নিরুৎসাহিত করবে না।
রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহন তার দায়িত্ব থেকে অবসর নিলেন, ত্রিশূলের দায়িত্ব চাপল কাপুরের কাঁধে। মিসাইল কমান্ড গাইডেন্স মোহন যেভাবে বুঝতেন আমি সবসময়ই তার অনুরাগী ছিলাম। এই নাবিক-শিক্ষক-বিজ্ঞানী এই ক্ষেত্রে দেশের অন্য আর সব বিশেষজ্ঞকে ছাড়িয়ে যেতে পারতেন। আমিত্রিশূল বিষয়ক মিটিংগুলোয় কমান্ড লাইন অব সাইট (সিএলওএস) গাইডেন্স সিস্টেমের নানা ধরণ নিয়ে তার মূল্যবান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কথা চিরদিন মনে রাখব। একবার তিনি আমাকে একটা কবিতা দেখিয়েছিলেন, তাতে তিনি আইজিএমডিপি-এর প্রকল্প পরিচালকের প্রতি ঋণ স্বীকারের তুলে ধরেন। নিঃশ্বাস ছাড়বার এটা ছিল একটা ভালো উপায়:
Impossible timeframes,
PERT charts to boot
Are driving me almost crazy as a coot;
Presentations to MC add to ones woes,
If they solve anything, Heaven only knows.
Meetings on holidays, even at night,
The family is fed up, And all readz to fight.
My hands are itching
to tear my hair–
But alas! I havent any more to tear…
আমি তাকে বলেছিলাম, আমার সব সমস্যা আমি হস্তান্তর করেছি ডিআরডিএল, আরসিআই, আর অংশগ্রহণকারী অন্যন্য গবেষণাগারে কর্মরত আমার সেরা দলগুলোর কাছে। আর সেজন্যই আমার মাথাভর্তি চুল রয়ে গেছে।
১৯৯১ সালটা শুরু হলো অত্যন্ত অশুভ একটা লক্ষণ নিয়ে। ১৫ জানুয়ারি ১৯৯১ সালের রাতে ইরাক ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর মধ্যে শুরু হয়ে গেল উপসাগরীয় যুদ্ধ। এক ধাক্কায় গোটা জাতির কল্পনা দখল করে নিল রকেট ও মিসাইল। লোকজন কফি হাউজ ও চায়ের দোকানে স্কাড ও প্যাট্রিওট ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। শিশুরা মিসাইলের আকৃতির ঘুড়ি ওড়াতে লাগল, আর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে লাগল। পঙ্খী ও ত্রিশূল-এর সফল পরীক্ষা উপসাগরীয় যুদ্ধের উত্তেজনা থেকে একটি জাতিকে স্বস্তি দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। পৃথ্বী ও ত্রিশূল গাইডেন্স সিস্টেমের প্রগ্রামেবল ট্র্যাজেক্টরি ক্যাপাবিলিটি সম্পর্কে সংবাদপত্রের খবর ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। গোটা জাতি আমাদের ওয়ারহেড ক্যারিয়ার ও উপসাগরীয় যুদ্ধে ব্যবহৃত মিসাইলের মধ্যে তুলনা করতে লাগল। তারা আলোচনা করতে লাগল পৃথ্বী কি স্কার্ডের চেয়েও শক্তিশালী, আকাশ কি প্যাট্রিওটের মতো লক্ষ্যভেদী, ইত্যাদি। আমার কাছ থেকে হাঁ অথবা কেন নয়? শুনে তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত গর্বে ও আত্মতৃপ্তিতে।