আমরা সৃষ্টি ও ধ্বংস করি
এবং আবার সৃষ্টি করি
এমন আকৃতিতে যা কেউ জানে না।
–আল-ওয়াকিয়াহু
কুরআন ৫৬ : ৬১
১৫.
১৯৯০ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে, মিসাইল কর্মসূচির সাফল্য উদযাপন করল জাতি। উ. অরুণাচলমের সঙ্গে আমাকেও পদ্মবিভূষণ পুরস্কার দেওয়া হলো। আমার অপর দুই সহকর্মী, জেসি ভট্টাচার্য ও আরএন আগরওয়াল, ভূষিত হলেন পদ্মশ্রী পুরস্কারে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই প্রতিষ্ঠানের এতজন বিজ্ঞানীর নাম যুক্ত হয়েছিল পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায়। আমাকে এক দশক আগে দেওয়া পদ্মভূষণ পুরস্কারের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ফিরে এসেছিল আবার। আমি কম-বেশি আগের মতোই জীবন যাপন করছিলাম-দশ ফুট চওড়া ও বারো ফুট লম্বা একটা কামরায়, সেটা সজ্জিত ছিল প্রধানত বই, কাগজ আর কয়েকটা ভাড়া করা আসবাবপত্রে। একমাত্র পার্থক্য আগের কামরাটা ছিল ত্রিবান্দ্রামে আর এবারেরটা হায়দারাবাদে। মেস বেয়ারা সকালের নাশতার জন্য আমার ইডলি ও বাটারমিল্ক নিয়ে এল আর পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমাকে নীরব আভিনন্দন জানাল হাসি দিয়ে। আমার দেশবাসীর এই স্বীকৃতি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। প্রচুর অর্থ রোজগারের জন্য বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী প্রথম সুযোগেই এ দেশ ছেড়ে চলে যান বিদেশে। এটা সত্যি যে তারা অবশ্যই বিশাল আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন, কিন্তু দেশের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে কি তার তুলনা চলে?
আমি কিছু সময় একাকী নীরব ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়ি। রামেশ্বরমের বালু ও শখ, রামনাথপুরমে ইয়াড়রাই সলোমনের তত্ত্বাবধান, ত্রিচিতে রেভারেন্ড ফাদার, সেকুয়েইরার এবং মাদ্রাজে অধ্যাপক পান্ডালাইয়ের পথনির্দেশনা, ব্যাঙ্গালোরে ড. মেডিরাট্টার উৎসাহ, অধ্যাপক মেননের সঙ্গে হোভারক্রাফটে উডডয়ন, ভোর হবার আগে অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে তিলপাটত পরিদর্শন, এসএলভি-৩ ব্যর্থতার দিন ড, ব্ৰহ্ম প্রকাশের নিরাময়ী স্পর্শ, এসএলভি-৩ উৎক্ষেপণে জাতীয় বিজয়োল্লাস, ম্যাডাম গান্ধীর সপ্রশংস উপলব্ধিমূলক হাসি, ভিএসএসসিতে এসএলভি-৩ পরবর্তী ফুটন্ত অবস্থা, ডিআরডিওতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে ড. রামান্নার বিশ্বাস, আইজিএমডিপি, আরসিআই সৃষ্টি, পৃথ্বী, অগ্নি… স্মৃতির বন্যা ভেসে গেল আমার ওপর দিয়ে। এসব মানুষ এখন কোথায়? আমার বাবা, অধ্যাপক সারাভাই, ড, ব্রহ্ম প্রকাশ? আবার যদি তাদের সঙ্গে দেখা হতো আর আমার আনন্দ ভাগ করে নিতে পারতাম। আমি অনুভব করি, স্বর্গের পৈত্রিক শক্তি আর প্রকৃতির মাতৃক ও বৈশ্বিক শক্তি পিতামাতার মতো আমাকে আলিঙ্গন করে, যেন বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে তারা ফিরে পেয়েছে। আমার ডাইরিতে আমি দ্রুত হাতে লিখলাম:
Away! fond thoughts, and vex my soul no more!
Work claimed my wakeful nights, my busy
days Albeit brought memories of Rameswaram shore
Yet haunt my dreaming gaze!
এক পক্ষকাল পরে, আয়ার ও তার দল নাগ-এর মেইডেন ফ্লাইট চালিয়ে মিসাইল কর্মসূচিতে একটা পুরস্কার যোগ করলেন। পরদিনও তারা এ পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন, এভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের প্রথম অল-কম্পোজিট এয়ারফ্রেম ও প্রপালসন সিস্টেমের দুইবার পরীক্ষা। দেশীয় থার্মাল ব্যাটারির মূল্যও প্রমাণিত হয়েছিল এসব পরীক্ষায়।
ফায়ার-অ্যান্ড-ফরগেট সামর্থযুক্ত তৃতীয় প্রজন্মের ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল সিস্টেমের অধিকারী হবার মর্যাদা অর্জন করেছিল ভারত। তা ছিল দুনিয়ার যে কোনো স্টেট-অব-দ্য আর্ট প্রযুক্তির সমান। দেশীয় কম্পোজিট প্রযুক্তি বড়ো একটা মাইলস্টোন অতিক্রম করেছিল। নাগ-এর সাফল্যও নিশ্চিত করেছিল কনসোর্টিয়াম অভিগমনের ফলপ্রদতা, যা পরিচালনা করেছিল অগ্নির সফল নির্মাণ।
নাগে ব্যবহার করা হয় প্রধান দুটো প্রযুক্তি-একটা ইমেজিং ইনফ্রা রেড (আইআইআর) সিস্টেম এবং একটা মিলিমেট্রিক ওয়েভ (এমএমডব্লিউ) সিকার রাডার। প্রথমটার গাইডিং আই হিসাবে। দেশের একক কোনো গবেষণাগারের সামর্থ্য ছিল না এসব প্রচণ্ড অগ্রবর্তী সিস্টেম তৈরি করার। কিন্তু সাফল্য লাভের তাগিদ ছিল, যা থেকে ফল পাওয়া গিয়েছিল কার্যকর যৌথ প্রচেষ্টায়। চন্ডিগড়ের সেমি কণ্ডাক্টর কমপ্লেক্স তৈরি করেছিল চার্জ কাপড ডিভাইস (সিসিডি) বিন্যাস। দিল্লির সলিড ফিজিক্স ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিল মার্কারি ক্যাডমিয়াম টেলুরাইড (এমসিটি) ডিটেকটর। দিল্লির ডিফেন্স সেন্টার (ডিএসসি) জলস টমসন এফেক্টের ওপর ভিত্তি করে গড়ে দিয়েছিল একটা দেশীয় কুলিং সিস্টেম। দেরাদুনের ডিফেন্স ইলেকট্রনিকস ল্যাবরেটরি (ডিইএএল) উদ্ভাবন করেছিল ট্রান্সমিটার রিসিভার ফ্রন্ট এন্ড।
স্পেশাল গ্যালিয়াম আর্সেনাইড গান, স্কটকি ব্যারিয়ার মিক্সার ডিওড়স, অ্যান্টেনা সিস্টেমের জন্য কমপ্যাক্ট কমপ্যারাটর-এসব উচ্চতর প্রযুক্তি ডিভাইসের সবগুলোর ক্ষেত্রে ক্রয় নিষেধাজ্ঞা চাপান হয়েছিল ভারতের ওপর। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা দিয়ে কখনও উদ্ভাবনা দমন করা যায় না।
.
আমি ওই মাসেই মাদুরাই কামারাজ ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম তাদের সমাবর্তনে ভাষণ দিতে। যখন মাদুরাইতে পৌঁছলাম, তখন আমার হাই স্কুল শিক্ষক ইয়াড়রাই সলোমনের কথা জিজ্ঞেস করলাম, এতদিনে তিনি রেভারেন্ড হয়েছিলেন আর তার বয়স হয়েছিল আশি বছর। আমাকে বলা হলো যে, মাদুরাইয়ের এক শহরতলিতে তিনি বাস করেন। আমি ট্যাক্সি নিয়ে তার বাড়িতে গেলাম। রেভারেন্ড সলোমন জানতেন, ওই দিন আমি সমাবর্তন ভাষণ দেব। কিন্তু সেখানে যাবার কোনো উপায় ছিল না তার। ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে এক হৃদয়স্পর্শী পুনর্মিলন ঘটল। ড. পিসি আলেকজান্ডার, তামিল নাড়ুর গভর্ণর, তিনি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করছিলেন, এটা দেখে খুব আলোড়িত হলেন যে বৃদ্ধ শিক্ষক তার বহু দিন আগের ছাত্রকে ভুলে যাননি, তিনি তাকে মঞ্চে আসন নেবার অনুরোধ জানালেন।