৫০০-এরও বেশি বিজ্ঞানী নিয়ে অগ্নির দল গঠন করা হয়েছিল। এই বিপুল কর্মকান্ডের নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল অনেক প্রতিষ্ঠান। অগ্নি মিশনে ছিল দুটো মূল নিশানা-কাজ এবং কর্মী। প্রত্যেক সদস্য তার দলের অন্যান্য সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল ছিল নিজ লক্ষ্য পূরণের জন্য। পরস্পরবিরোধিতা বা বিভ্রান্তি ঘটা এমন অবস্থায় খুবই স্বাভাবিক। কিছু নেতা কাজ করিয়ে নেবার সময় কর্মীদের জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাও লালন করতেন, তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত পন্থায়। অন্যরা শুধু কাজ আদায়ের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতেন। তারা মানুষকে লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। কেউ কেউ কাজের প্রতি কম গুরুত্ব দেন, আর তাদের সঙ্গে কর্মরত লোকদের উষ্ণতা ও অনুমোদন প্রাপ্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু এই দল যা অর্জন করেছিল তা হলো মানব সম্পর্কের ও কর্মকুশলতার সম্ভব সর্বোচ্চ একীভবন।
সংশ্লিষ্টতা, অংশগ্রহণ ও অঙ্গীকার ছিল কর্মযোগের মূল কথা। দলের প্রত্যেক সদস্য কাজ করত এমনভাবে যেন নিজের পছন্দে কাজ করছে। অগ্নি উৎক্ষেপণের ব্যাপারটি আমাদের বিজ্ঞানীদের জন্য তো বটেই, এমনকি তাদের পরিবারগুলোর জন্যও ছিল বিশাল এক বাজি। ভিআর নাগরাজ ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইন্টিগ্রেশন দলের নেতা ছিলেন এমনই নিবেদিত প্রাণ প্রযুক্তিবিদ যে কাজের সময় খাওয়া এবং ঘুমের কথাও ভুলে যেতেন। তিনি আইটিআর-এ থাকাকালে তার ভগ্নিপতি মারা যান। তার পরিবার এই খবর নাগরাজের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছিল, যাতে করে তার কাজে কোনো বাধা না পড়ে।
অগ্নি উৎক্ষেপণের তারিখ নির্ধারিত ছিল ১৯৮৯ সালের ২০ এপ্রিল। এটা হতে যাচ্ছিল এক নজিরবিহীন মহড়া। মিসাইল উৎক্ষেপণের সঙ্গে জড়িত ছিল। ওয়াইড রেঞ্জিং নিরাপত্তার বিপদের আশঙ্কা, যার সঙ্গে স্পেস লঞ্চ ভেহিকলের কোনো মিল নেই। মিসাইল ট্রাজেক্টরি মনিটর করার জন্য কাজে লাগান হয়েছিল দুটো রাডার, তিনটে টেলিমেট্রি স্টেশন, একটা টেলিকমান্ড স্টেশন ও চারটে ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল ট্র্যাকিং ইস্ট্রমেন্ট। ভেহিকল ট্র্যাক করতে আরও নিযুক্ত করা হয়েছিল কার নিকোবর (আইএসটিআরএসি)-এ টেলিমেট্রি স্টেশন এবং এসএইচএআরের রাডারগুলো। ডাইনামিক সার্ভেইল্যান্স নিয়োগ করা হয়েছিল কন্ট্রোল সিস্টেম প্রেসার এবং বৈদ্যুতিক শক্তির দিকটা কভার করার জন্য যা ভেহিকলের মধ্যে মিসাইল ব্যাটারি থেকে প্রবাহিত হয়। ভোল্টেজে অথবা প্রেসারে অন্য কোনো গড়মিল লক্ষ্য করতে বিশেষভাবে ডিজাইন করা স্বয়ংক্রিয় চেকআউট সিস্টেম সংকেত দেবে Hold। ক্রটি মেরামতের পর ফ্লাইট অপারেশন পরিকল্পনা মাফিক চলবে। কাউন্টডাউন শুরু হবে টি-৩৬ ঘন্টায়। টি-৭.৫ মিনিট থেকে কাউন্টডাউন নিয়ন্ত্রিত হবে কম্পিউটারে।
.
উৎক্ষেপণের জন্য সকল প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে চলল শিডিউল অনুয়ায়ী। উৎক্ষেপণকালে নিকটবর্তী গ্রামবাসীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। এ বিষয়টা সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়ল, আর শুরু হয়ে গেল বিপুল বিতর্ক। ২০ এপ্রিল যখন এল, পুরো জাতির নজর তখন আমাদের ওপর।
ফ্লাইট ট্রায়াল বন্ধ করার জন্য বিদেশী চাপ এসেছিল কূটনৈতিক চ্যানেলের ভেতর দিয়ে, কিন্তু ভারত সরকার আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল পাথরের মতো। টি ১৪ সেকেন্ডের সময় কম্পিউটার সংকেত দিল Hold আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরও অসংখ্য Hold আসতে লাগল। উৎক্ষেপণ স্থগিত করতে হলো আমাদের অন বোর্ড পাওয়ার সাপ্লাই বদলানোর জন্য মিসাইল খুলে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল। এর মধ্যে পরিবারের একজনের মৃত্যুর খবর জানান হয়েছিল নাগরাজকে। ক্রন্দনরত নাগরাজ আমার সঙ্গে দেখা করলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি তিন দিনের মধ্যে ফিরে আসবেন। এইসব সাহসী মানুষদের কথা কোনো ইতিহাস গ্রন্থে কোনোদিন লেখা হবে না। কিন্তু এই রকম নীরব মানুষদের কঠোর পরিশ্রমেই দেশের উন্নতি হয়েছে। নাগরাজকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আমার দলের সবার সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করলাম যারা মানসিক আঘাত আর দুঃখে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। আমার এসএলভি-৩ এর অভিজ্ঞতার কথা তাদের বললাম। আমার লঞ্চ ভেহিকল পড়েছিল সমুদ্রে, কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে তা পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। আপনাদের মিসাইল তো আপনাদের চোখের সামনেই রয়েছে। প্রকৃত পক্ষে আপনারা কিছুই হারাননি, শুধু কয়েক সপ্তাহ আবার কাজ করতে হবে। তাদের অচলতাকে এটা আঁকুনি দিল এবং গোটা দল সাবসিস্টেমের সমস্যা সমাধানে ফিরে গেল।
সংবাদপত্র পিছু লেগে গেল দারুণভাবে। পাঠকের উদ্ভট কল্পনার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী করে ফ্লাইট স্থগিতের বিষয়টি তুলে ধরল। কার্টুনিস্ট সুধীর ধর স্কেচ আঁকলেন, একজন দোকানদার সেলসম্যানের কাছে একটা পণ্য ফেরত দিয়ে বলছে যে অগ্নির মতো এটাও চলবে না। আরেকজন কার্টুনিস্ট দেখালেন, অগ্নির একজন বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা করছেন যে উৎক্ষেপণ স্থগিতের কারণ প্রেস বাটন স্পর্শ করাই হয়নি। হিন্দুস্তান টাইমস দেখাল, একজন নেতা সাংবাদিকদের বলছেন, আতংকিত হবার কিছু নেই… এটা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ, অহিংস মিসাইল
পরবর্তী দশদিন ঘড়ির কাটা ধরে প্রতিটা মুহূর্তে বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর আমাদের বিজ্ঞানীরা মিসাইলটিকে ১৯৮৯ সালের ১ মে উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত করে ফেললেন। কিন্তু আবারও, টি-১০ সেকেন্ডে স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার চেকআউট পিরিয়ডের সময় একটা Hold সংকেত পাওয়া গেল। নিবিড় তদন্তে দেখা গেল, নিয়ন্ত্রণের অন্যতম অংশ এস১-টিভিসি ঠিকমতো কাজ করছে না। উৎক্ষেপণ আবারও স্থগিত করা হলো। এখন, এ ধরনের ঘটনা রকেট বিজ্ঞানে খুবই সাধারণ একটা বিষয় আর অন্যান্য দেশেও প্রায়ই ঘটে থাকে। কিন্তু প্রতীক্ষমান জাতির মেজাজ ছিল না আমাদের অসুবিধাগুলো বোঝার। হিন্দু পত্রিকায় মুদ্রিত কেশবের আঁকা একটা কানে দেখা গেল, একজন গ্রামবাসী কিছু কারেন্সি নোট গুনছে আর অপর একজনের কাছে মন্তব্য করছে: হ্যাঁ, এই হলো পরীক্ষা স্থলের নিকটবর্তী আমার কুটির থেকে সরে যাওয়ার খেসারত আরও কয়েকবার স্থগিতের ঘটনা ঘটলে নিজের জন্য একটা দালান তুলতে পারব…। আরেকজন কার্টুনিস্ট অগ্নিকে আখ্যা দিল আইডিবিএম-ইন্টারমিটেন্টলি ডিলেইড ব্যালিস্টিক মিসাইল। আমুলের কার্টুনে পরামর্শ দেওয়া হলো যে, অগ্নির যা করা দরকার তা হলো জ্বালানি হিসাবে তাদের বাটার ব্যবহার করা!