স্কুল শেষ হবার পর আমরা বাড়ি ফিরে গেলাম আর আমাদের শ্রদ্ধেয় বাবামাকে এই ঘটনা সম্পর্কে বললাম। লক্ষ্মণা শাস্ত্রী ঐ শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন এবং আমাদের উপস্থিতিতে তাকে বললেন যে নির্দোষ শিশুদের অন্তরে সামাজিক অসাম্য ও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়ানো তার উচিৎ নয়। তিনি শিক্ষককে বললেন হয় ক্ষমা চাইতে নয়তো স্কুল ছেড়ে দিয়ে দ্বীপ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে। শিক্ষক শুধু তার ব্যবহারের জন্যেই দুঃখ প্রকাশ করলেন তা নয় লক্ষ্মণা শাস্ত্রীর সুদৃঢ় মনোভাব তার মনটাকে সংস্কারও করে দিলো।
সামগ্রিকভাবে রামেশ্বরমের ছোটো সমাজটি ছিল বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষদের নিয়ে গঠিত। যাই হোক, আমার বিজ্ঞান শিক্ষক শিবসুবামানিয়া আয়ার ছিলেন এক ধরনের বিদ্রোহী, যদিও তিনি নিজে ছিলেন গোড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের এবং তার স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল। সামাজিক বাধাগুলো ভেঙে ফেলার জন্য তিনি সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়েছিলেন যাতে করে বিভিন্ন স্তরের লোকজন সহজভাবে পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে। তিনি আমার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতেন এবং বলতেন, কালাম, আমি তোমার উন্নতি চাই যাতে করে বড়ো শহরের উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তুমি অবস্থান করতে পারো।
একদিন তিনি আমাকে তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। তার স্ত্রী ধর্মীয়ভাবে পবিত্র তার রান্নাঘরে বসে খাওয়ার জন্য একজন মুসলমান বালককে নিমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে এই চিন্তায় আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। রান্নাঘরে তিনি আমাকে খাবার দিতে অস্বীকার করলেন। শিবসুব্রামানিয়া আয়ার মোটেও থমকে গেলেন না, স্ত্রীর প্রতি রাগও করলেন না, বরং তিনি আমাকে নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করলেন এবং খাবার খাওয়ার জন্য আমার পাশেই বসে পড়লেন। তার স্ত্রী রান্নাঘরের দরজার পেছন থেকে আমাদের লক্ষ্য করতে লাগলেন। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবলাম যেভাবে আমি ভাত খেলাম, পানি পান করলাম কিংবা খাবার পর মেঝে পরিষ্কার করলাম তার মধ্যে কোনো পার্থক্য তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন কিনা। তার বাড়ি থেকে চলে আসার সময় শিবসুব্রামানিয়া আয়ার আবারও তার সঙ্গে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন আমাকে পরের সপ্তাহান্তে। আমার ইতস্ততভাব লক্ষ করে তিনি আমাকে হতাশ হতে নিষেধ করে বললেন, একবার যদি তুমি প্রথা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নাও, তাহলে এ ধরনের সমস্যা তোমাকে মোকাবেলা করতে হবে। পরের সপ্তাহে আমি যখন তার বাড়িতে গেলাম, শিবসুব্রামানিয়া আয়ারের স্ত্রী আমাকে তার রান্নাঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন এবং নিজের হাতে আমাকে খাবার দিলেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল। আর ভারতের স্বাধীনতাও ছিল অত্যাসন্ন। ভারতীয়রা নিজেরাই নির্মাণ করবে নিজেদের ভারত, ঘোষণা দিলেন গান্ধীজী। এক অপরিমেয় আশাবাদে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল সারা দেশ। জেলা সদর রামনাথপুরম-এ গিয়ে লেখাপড়ার জন্য রামেশ্বরম ত্যাগ করার অনুমতি চাইলাম আমি বাবার কাছে।
.
যেন সশব্দে চিন্তা করছেন এমনভাবে তিনি বললেন, আবুল! আমি জানি বড়ো হবার জন্য তোমাকে দূরে যেতে হবে। সূর্যের নীচে কি সিগাল ওড়ে না, একাকী ও বাসাহীন? তোমার বিশাল আকাঙ্ক্ষার স্থানে পৌঁছানোর জন্য তোমার স্মৃতির দেশের প্রতি তোমার আকুল আকাক্ষা অবশ্যই তুমি ছাড়িয়ে যাবে, আমাদের ভালোবাসা তোমাকে বঁধবে না আর আমাদের প্রয়োজনও তোমাকে আটকে রাখবে না। কাহলিল জিবরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আমার দ্বিধাগ্রস্থ মাকে বললেন, তোমার সন্তান তোমার নয়। তারা জীবনের পুত্র ও কন্যা। তারা। তোমার ভেতর দিয়ে এসেছে কিন্তু তোমার থেকে আসেনি। তুমি তাকে হয়তো তোমার ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমার চিন্তা দিতে পার না। যেহেতু তাদের নিজস্ব চিন্তা আছে।
তিনি আমাকে ও আমার তিন ভাইকে মসজিদে নিয়ে গেলেন এবং পবিত্র কুরআন থেকে সুরা আল ফাতিহা পাঠ করলেন। রামেশ্বরম স্টেশনে ট্রেনে আমাকে তুলে দিয়ে তিনি বললেন, এই দ্বীপ হয়তো তোমার দেহের আবাস হতে পারে কিন্তু তোমার আত্মার নয়। তোমার আত্মা বাস করে আগামীর বাড়িতে যেখানে রামেশ্বরমের আমরা কেউই যেতে পারি না, এমনকি আমাদের স্বপ্নেও নয়। স্রষ্টা তোমার মঙ্গল করুন, আমার বাছা!
শামসুদ্দিন ও আহমেদ জালালুদ্দিন রামনাথপুরম পর্যন্ত আমার সঙ্গে এলো আমাকে শোয়ার্টজ হাই স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া এবং সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। রামনাথপুরম ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের একটা দুর্দান্ত শহর, কিন্তু রামেশ্বরমের বৈচিত্র্য এবং সুসঙ্গতি সেখানে ছিল অনুপস্থিত। আমি বাড়ির অভাব খুবই অনুভব করতাম আর রামেশ্বরমে যাবার প্রতিটা সুযোগই আঁকড়ে ধরতাম। রামনাথপুরমে শিক্ষা সুযোগের টান মোটেও জোরালো ছিল না অন্তত আমার মায়ের তৈরি দক্ষিণ ভারতীয় মিষ্টি পোলির আকর্ষণের চেয়ে। বস্তুত বারো প্রকার এই মিষ্টি তিনি তৈরি করতে পারতেন, যেসব উপাদান দিয়ে মা এই মিষ্টি তৈরি করতেন তার প্রত্যেকটার আলাদা সৌরভ বের করে আনার সামর্থ্য ছিল তার।
আমার গৃহকাতরতা সত্ত্বেও নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আমি দৃঢ়চিত্ত ছিলাম, কারণ আমি জানতাম বাবা আমার সাফল্য সম্পর্কে বিপুল আশা করেছিলেন। বাবা আমাকে কালেক্টর হিসাবে কল্পনা করেছিলেন এবং আমি ভেবেছিলাম বাবার স্বপ্ন বাস্তব করে তোলা আমার কর্তব্য, যদিও রামেশ্বরমের আরাম আয়েশ, নিরাপত্তা ও পরিচিত বলয়ের অভাব আমি দুর্দান্তভাবে অনুভব করছিলাম।