উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৮৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ১১:২৩ ঘন্টায়। দেশের রকেট বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা ছিল এক মহাকাব্যিক ঘটনা। সারফেস-টু-সারফেস মিসাইল পৃথ্বী ১৫০ কিলোমিটার দূরে ১০০০ কেজি কনভেনশনাল ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম আর নির্ভুলতার পরিমাণ ৫০ মিটার সিইপি। তবে আসল কথা হলো, ভবিষ্যতের সকল গাইডেড মিসাইলের জন্য এটা ছিল বেসিক মডিউল। লং-রেঞ্জ সারফেস থেকে এটিকে রূপান্তরিত করা যায় এয়ার মিসাইল সিস্টেমে, এ ছাড়াও জাহাজেও মোতায়েন করা যেতে পারে।
মিসাইলের নির্ভুলতা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় এর সার্কুলার এরর ব্যাবল (সিইপি)-এ। এটা একটা বৃত্তের রেডিয়াস পরিমাপ করে যার মধ্যে নিক্ষিপ্ত মিসাইলের ৫০ শতাংশ সংঘৃষ্ট হবে। অন্য কথায়, কোনো মিসাইলের যদি ১ কিলোমিটার সিইপি থাকে (উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত ইরাকি স্কাড ক্ষেপণাস্ত্রের যেমনটা ছিল), তাহলে তার অর্থ হলো এগুলোর অর্ধেক সংঘৃষ্ট হবে লক্ষ্যস্থলের ১ কিলোমিটারের মধ্যে। ১ কিলোমিটার সিইপি ও কনভেনশনাল হাই-এক্সপ্লোসিভ ওয়ারহেড যুক্ত একটা মিসাইল দিয়ে স্বাভাবিকভাবে আশা করা যাবে না যে, সেটা স্থির সামরিক লক্ষ্যবস্তুসমূহ যেমন কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল ফ্যাসিলিটি বা এয়ার বেজ অচল বা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হবে। এটা শহরের মতো অনিশ্চিত লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর।
১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের মার্চের মধ্যে জার্মান V-2 মিসাইল বর্ষণ করা হয় লন্ডনে। ওইসব মিসাইলে যুক্ত ছিল কনভেনশনাল হাইএক্সপ্লোসিভ ওয়ারহেড ও বৃহদাকার ১৭ কিলোমিটারের সিইপি। লন্ডনে হানা ৫০০টি v.2 ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২১,০০০-এরও বেশি আর ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ২০০০০০।
এনপিটি নিয়ে পশ্চিমারা যখন কর্কশ সুরে চিৎকার করছিল, আমরা তখন ৫০ মিটারের একটা সিইপি তৈরির দিকে এগিয়ে চলেছি। পৃথ্বীর সকল পরীক্ষার পর, পারমাণবিক ওয়ারহেড ছাড়াই একটা সম্ভাব্য কৌশলগত আক্রমণের শীতল বাস্তবতা মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল সেইসব সমালোচকদের যারা একটা টেকনোলজি কন্সপিরেসি বিষয়ে ফিসফাস করছিল।
পৃথ্বী উৎক্ষেপণ বৈরী ভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশগুলোয় একটা শক-ওয়েভ সৃষ্টি করেছিল। পশ্চিমা ব্লক প্রথমে স্তম্ভিত ও পরে ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ল। সাতটি রাষ্ট্র আমাদের ওপর প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিল, ভারতের পক্ষে একেবারে অসম্ভব করে তুলল এমনকি গাইডেড মিসাইলের সঙ্গে যোগ নেই এমন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনাও। গাইডেড মিসাইল ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসাবে ভারতের উত্থান বিশ্বের সব কটি উন্নত রাষ্ট্রের মেজাজ বিগড়ে দিয়েছিল।
.
১৪.
রকেট বিজ্ঞানে ভারতের মৌলিক সামর্থ্য আবারও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বেসামরিক স্পেস ইন্ডাস্ট্রি ও টিকে থাকার শক্তিসম্পন্ন মিসাইল ভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতকে সেইসব গুটিকয় রাষ্ট্রের সারিতে উন্নীত করেছিল যারা নিজেদের বলে পরাশক্তি। বুদ্ধ ও গান্ধীর শিক্ষাকে অনুসরণ করেও কেন এবং কীভাবে ভারত মিসাইল পাওয়ারে পরিণত হলোএই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে ভবিষ্যৎ প্রজনের জন্য।
দুই শতাব্দীর নিপীড়ন, নির্যাতনও পারেনি ভারতীয় জনগণের সৃষ্টিশীলতা ও সামর্থ্যকে হত্যা করতে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের মাত্র এক দশকের মধ্যেই ইন্ডিয়ান স্পেস অ্যান্ড অ্যাটমিক এনার্জি প্রগ্রাম চালু করা হয়েছিল। এর লক্ষ ছিল শান্তিপূর্ণ ব্যবহার। মিসাইল ডেভলপমেন্টে বিনিয়োগের কোনো তহবিলও ছিল না, কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে তেমন তাগাদাও ছিল না। ১৯৬২ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতাই আমাদের বাধ্য করেছিল মিসাইল ডেভলপমেন্টের দিকে প্রথম পদক্ষেপ নিতে।
একটা পৃথীই কি যথেষ্ট? চার অথবা পাঁচটা মিসাইল সিস্টেমের দেশীয় উৎপাদন কি আমাদের যথেষ্ট শক্তিশালী করতে পারে? পারমাণবিক অস্ত্র কি আমাদের আরও শক্তিশালী করতে পারে? মিসাইল ও অ্যাটোমিক অস্ত্র আসলে একটা বৃহত্তর বস্তুরই দুটো অংশ। অগ্রসর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পৃথ্বী উৎপাদন আমাদের দেশের আত্মনির্ভরশীলতা তুলে ধরেছে। উঁচু প্রযুক্তি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা আর ব্যাপক অবকাঠামোর সমার্থক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসবের কোনোটিই পর্যাপ্ত ছিল না। কাজেই আমরা কি করতে পারতাম? প্রযুক্তি প্রদর্শনের প্রকল্প হিসাবে তৈরি করা অগ্নি কি এসবের উত্তর হতে পারত? যে মিসাইল তৈরি করতে দেশের সহজলভ্য সব উৎসগুলো কাজে লাগান হয়েছিল।
প্রায় এক দশক আগে আইএসআরও-তে আমরা আরইএক্স নিয়ে আলোচনা করার সময়ও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, একত্রে কর্মরত ভারতীয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের এই টেকনোলজিক্যাল ব্রেকথ্র অর্জনের সামর্থ্য রয়েছে। ভারত অতি নিশ্চিতভাবেই স্টেট-অব-দ্য-আর্ট টেকনোলজি অর্জন করতে পারে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আর এটা করার জন্য আমরা তিন স্তরের একটা কৌশল অবলম্বন করলাম-বহু প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ, কনসোর্টিয়াম মনোভাব, এবং প্রযুক্তির বলবৃদ্ধি। এই পাথরগুলো ঘষেই সৃষ্টি করা হয়েছিল অগ্নি।