আরেক ব্যক্তি যে আমার শৈশবের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল সে হচ্ছে আমার প্রথম চাচাত ভাই শামসুদ্দিন। রামেশ্বরমে সে ছিল সংবাদপত্রের একমাত্র পরিবেশক। পাষান থেকে সকালের ট্রেনে রামেশ্বরম স্টেশনে এসে পৌঁছোত সংবাদপত্রগুলো। শামসুদ্দিনের সংবাদপত্র এজেন্সি ছিল একক ব্যক্তির একটা সংগঠন। রামেশ্বরম শহরের এক হাজার শিক্ষিত মানুষের পড়ার চাহিদা মেটাতে সে। এই সংবাদপত্রগুলো প্রধানত কেনা হতো জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চলমান অগ্রগতি সম্পর্কে টাটকা খবরাখবর জানার জন্য। এছাড়াও রাশিফল ইত্যাদি জানাও ছিল পাঠকের লক্ষ। বহুজাতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন কিছু পাঠক আলোচনা করত হিটলার, মহাত্মা গান্ধী ও জিন্নাহকে নিয়ে। সবকিছুই শেষ পর্যন্ত একটা বিষয়ের দিকেই ধাবিত হতো আর সেটা হলো উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিরুদ্ধে। পেরিয়ার ইভি রামস্বামীর আন্দোলনের বিপুল রাজনৈতিক প্রবাহ। দিনমনি ছিল সর্বাধিক বিক্রিত সংবাদপত্র। যেহেতু মুদ্রিত বিষয় পড়ার সামর্থ্য তখনও আমার হয়নি, তাই শামসুদ্দিন তার গ্রাহকদের কাছে সংবাদপত্রগুলো বিলি করার আগে সেগুলোয় প্রাকশিত ছবিতে নজর বুলিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট হতে হতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে, তখন আমার বয়স আট বছর। কখনই আমি বুঝতে পারিনি এমন সব কারণে বাজারে হঠাৎ করেই বেড়ে গেল তেঁতুলবিচির চাহিদা। আমি তেঁতুলবিচি সংগ্রহ করে মস্ক স্ট্রিটের একটা দোকানে বিক্রি করতে থাকি। এক দিনের সংগ্রহে যে এক আনা দাম পেতাম তাতেই নিজেকে রাজকুমার মনে হতো। যুদ্ধ সম্পর্কে জালালুদ্দিন আমাকে গল্প শোনাত, পরে তার চিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাতাম আমি দিনমন্ত্রি সংবাদ-শিরোনামে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে আমাদের এলাকা পুরোপুরিভাবে যুদ্ধের প্রভাবমুক্ত ছিল। কিন্তু খুব শীঘ্রই মিত্রবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হলো ভারত এবং জরুরি অবস্থার মতো একটা ঘোষণা দেওয়া হলো। রামেশ্বরম স্টেশনে ট্রেন না থামার অনিশ্চয়তা হিসাবে প্রথম ক্ষয়ক্ষতি দেখা দিল। সংবাদপত্রগুলো এখন বান্ডিল করে চলন্ত ট্রেন থেকে ছুঁড়ে দেওয়া হতো রামেশ্বরম ও ধানুসকোডির মধ্যবর্তী রামেশ্বরম রোডে। এর ফলে বান্ডিল ধরার কাজে একজন সাহায্যকারী খুঁজে নিতে বাধ্য হলো শামসুদ্দিন আর, যেন স্বাভাবিকভাবেই, আমাকেই নিয়োগ করা হলো ওই কাজে। এভাবে আমার প্রথম রোজগার অর্জনে সাহায্য করল শামসুদ্দিন। অর্ধশতাব্দী পর, এখনও আমি প্রথমবারের মতো নিজের অর্থ উপার্জনের সেই গর্ব অনুভব করি।
প্রতিটা শিশুই কিছু পরিমাণ বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। একটা নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক ও আবেগপূর্ণ পরিবেশে, আর নির্দিষ্ট পন্থায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয় কর্তাপক্ষীয় ব্যক্তিদের দ্বারা। আমি বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছিলাম সততা ও আত্ম-শৃঙখল; মায়ের কাছ থেকে ধার্মিকতা ও গভীর দয়ালুতার বিশ্বাস। আমার মতো আমার তিন ভাই ও বোনও এসব পেয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। কিন্তু জালালুদ্দিন ও শামসুদ্দিনের সঙ্গে যে সময় আমি কাটিয়েছিলাম, সেই সময়ই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল আমার শৈশবের অনন্যতায়, এবং আমার পরবর্তী জীবনে সকল পার্থক্য রচনা করে দিয়েছিল।
শৈশবে আমার তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল-রামানাধা শাস্ত্রী, অরবিন্দন ও শিবপ্রকাশন। এরা ছিল গোঁড়া হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। শিশু ছিলাম বলেই আমাদের ধর্মীয় পার্থক্য ও লালনপালন থেকে সৃষ্ট কোনো পার্থক্যই নিজেদের মধ্যে আমরা কেউই অনুভব করতাম না। বস্তুত রামানাধা শাস্ত্রী ছিল পক্ষী লক্ষ্মণ শাস্ত্রীর ছেলে, পক্ষী ছিলেন রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। পরে রামানাধা রামেশ্বরম মন্দিরের পৌরহিত্যের দায়িত্ব নিয়েছিল তার বাবার কাছ থেকে, সফররত তীর্থযাত্রীদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থার ব্যবসায় জড়িয়েছিল অরবিন্দন এবং শিবপ্রকাশন ক্যাটারিং কন্ট্রাক্টর হিসাবে কাজ নিয়েছিল সাউদার্ন রেলওয়েজে।
বার্ষিক শ্রীসীতারামকল্যাণম উৎসব চলাকালে আমাদের পরিবার মন্দির থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে প্রভুর প্রতীক নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে তৈরি পাটাতনযুক্ত নৌকার ব্যবস্থা করত, অনুষ্ঠানস্থলটি ছিল পুকুরের মাঝখানে আর ঐ জায়াগটিকে বলা হতো রামতীর্থ, জায়গাটা ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছেই। আমার মা ও দাদী রাতের বেলা বিছানায় আমাদের পরিবারের বাচ্চাদের রামায়ণ থেকে নানা কাহিনি এবং রসুলের জীবনের নানা গল্প শোনাতেন। রামেশ্বরম এলিমেন্টারি স্কুলে আমি যখন ফিফথ-স্টান্ডার্ড এর ছাত্র তখন একদিন নতুন এক শিক্ষক এলেন আমাদের ক্লাসে। আমি একটা টুপি পরতাম মাথায় যাতে করে বোঝা যেত আমি একজন মুসলিম এবং আমি সবসময় সামনের সারিতে রামানাধা শাস্ত্রীর পাশে বসতাম, সে একটা পৈতে পরত। মুসলিম এক বালকের সঙ্গে একজন হিন্দু পুরোহিতের পুত্র বসবে তা সহ্য করতে পারলেন না নতুন শিক্ষক। তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আমাদের সামাজিক মর্যাদা মোতাবেক আমাকে বলা হলো উঠে গিয়ে পেছনের বেঞ্চিতে বসতে। আমি খুব দুঃখ অনুভব করলাম, আর রামানাধা শাস্ত্রীও দুঃখ পেল। পেছনের সারিতে যখন আমি চলে গেলাম তখন সে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। পেছনের সারিতে আমি চলে যাবার সময় তার কান্নার দৃশ্য একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে রাখলো আমার মনের ওপর।