আমার মনে পড়ে সূর্যোদয়ের আগে, নামাজ আদায়ের ভেতর দিয়ে আমার বাবা তার দিন শুরু করতেন ভোর ৪টায়। নামাজ শেষে তিনি পায়ে হেঁটে আমাদের ছোটো নারকেল বাগানে যেতেন, আমাদের বাড়ি থেকে বাগানটা ছিল প্রায় ৪ মাইল দূরে। এক সঙ্গে বাঁধা প্রায় এক ডজন নারকেল কাঁধে নিয়ে তিনি ফিরে আসতেন, এরপরই নাশতা খেতেন। বয়স ষাট বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এই ছিল তার রুটিন।
আমি সারা জীবন ধরে আমার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জগতের ভেতর দিয়ে চেষ্টা। করেছি বাবার সমকক্ষ হতে। যে মৌলিক সত্য বাবা আমার কাছে উন্মোচন করেছিলেন তা বোঝার জন্য আমি প্রবল চেষ্টা করেছি, আর এই বিশ্বাস অনুভব করেছি যে ঐশ্বরিক শক্তি বলে কোনো সত্ত্বা রয়েছে, যে সত্ত্বা মানুষকে বিভ্রম, দুর্দশা, বিষণ্ণতা ও ব্যর্থতা থেকে তুলে নিতে পারে এবং পথ প্রদর্শন করে মানুষকে তার প্রকৃত স্থানে নিয়ে যেতে পারে এবং একবার যদি কোনো ব্যক্তি তার আবেগ ও শরীরগত দাসত্বকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, তাহলেই সে পেয়ে যায় মুক্তি, সুখ ও মানসিক প্রশান্তির পথ।
আমার বাবা যখন রামেশ্বরম থেকে ধানুসকোডি (সেথুক্কারাই নামেও পরিচিত) পর্যন্ত ধর্মযাত্রা করে ফিরে আসার জন্য একটা কাঠের নৌকা তৈরি করার পরিকল্পনা নিলেন, তখন আমার বয়স প্রায় ছয় বছর। আহমেদ জালালুদ্দিন নামের এক আত্মীয়ের সহায়তা নিয়ে আমার বাবা নৌকাটি নির্মাণ করছিলেন সাগরতীরে। জালালুদ্দিন পরে আমার বোন জোহরাকে বিয়ে করেছিল। আমি লক্ষ করি নৌকাটি আকার নিচ্ছে। কাঠের আগুনের উত্তাপ দিয়ে পানিরোধক বেষ্টনী ও কাঠাম টেকসই করা হয়েছিল। আমার বাবার নৌকা নির্মাণের কাজ ভালোই এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু একদিন ঘন্টায় ১০০ মাইল গতিবেগের সাইক্লোন সেথুক্কারাইয়ের আরও কিছু জিনিসের সঙ্গে আমাদের নৌকাটিও উড়িয়ে নিয়ে গেল। যাত্রীবোঝাই ট্রেন নিয়ে ভেঙে পড়ল পাষান ব্রিজ। এ ঘটনার আগ পর্যন্ত আমি কেবল সমুদ্রের সৌন্দর্যই দেখেছিলাম, এখন এর অনিয়ন্ত্রণযোগ্য শক্তি একটা রহস্যের প্রকাশ হিসাবে দেখা দিল আমার কাছে।
.
নৌকাটির অসময়ে সমাপ্তি যতদিনে ঘটল, ততদিনে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে আহমেদ জালালুদ্দিন, বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও। সে আমার চেয়ে প্রায় ১৫ বছরের বড়ো ছিল আর আমাকে আজাদ নামে ডাকত। প্রতি সন্ধ্যায় এক সঙ্গে আমরা অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটতে বেরোতাম। মস্ক স্ট্রিট থেকে হাঁটতে আরম্ভ করে আমরা দ্বীপের বালুময় তীরের দিকে এগিয়ে যেতাম, ওই সময়টায়, জালালুদ্দিন ও আমি কথা বলতাম প্রধানত আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে। নানারকম তীর্থের কারণে ওই ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করার মতোই পরিবেশ ছিল রামেশ্বরমে। আমরা প্রথমে এসে থামতাম শিব মন্দিরে। এই মন্দিরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে, দেশের দূরতম প্রান্ত থেকে আসা যে কোনো তীর্থযাত্রীর মতো আমরাও, অনুভব করতাম যেন আমাদের ভেতর দিয়ে শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে।
স্রষ্টা সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলত জালালুদ্দিন যেন স্রষ্টার সঙ্গে তার কাজের অংশীদারিত্ব ছিল। তার সমস্ত সন্দেহ সে স্রষ্টার কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করত যেন সে সব নিরসন করার জন্য স্রষ্টা খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি অপলকে তাকিয়ে থাকতাম জালালুদ্দিনের দিকে। তারপর তাকাতাম মন্দিরের চারপাশে জড়ো হওয়া তীর্থযাত্রীদের বিশাল ভিড়ের দিকে, তারা সমুদ্রে পূণ্যস্নান করছে, আচারঅনুষ্ঠান পালন করছে এবং প্রার্থনা উচ্চারণ করছে শ্রদ্ধার মনোভাব নিয়ে সেই একই অজ্ঞাতের উদ্দেশ্যে, যাকে আমরা নিরাকার সর্বশক্তিমান হিসাবে মান্য করি। আমি কখনও সন্দেহ করিনি যে আমাদের মসজিদের প্রার্থনা যেখানে পৌঁছায়, সেই একই গন্তব্যে পৌঁছায় মন্দিরের প্রার্থনাও। আমি শুধু বিস্ময়ে ভাবতাম যে স্রষ্টার সঙ্গে জালালুদ্দিনের অন্য আর কোনো বিশেষ যোগাযোগ আছে কিনা। জালালুদ্দিনের বিদ্যালয়ের লেখাপড়া ছিল সীমিত, প্রধানত তাদের পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে। হয়তো এ কারণেই আমার লেখাপড়া অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সে আমাকে সবসময় উৎসাহ জোগাত আর দারুণ আনন্দে উপভোগ করত আমার সাফল্য। নিজের ভাগ্য বিড়ম্বনার জন্য জালালুদ্দিনকে কখনও আফসোস করতে দেখিনি আমি। বরং জীবন তাকে যা দিয়েছে তাতেই পূর্ণ কৃতজ্ঞ ছিল সে সবসময়।
ঘটনাক্রমে যে সময়ের কথা আমি বলছি, সেই সময়ে সারা দ্বীপে সে ছিল। একমাত্র ব্যক্তি যে ইংরেজি লিখতে পারত। প্রয়োজন হলে যে-কোনো লোকের চিঠি লিখে দিত সে। আমার পরিবারে কিংবা প্রতিবেশিদের মধ্যেও জালালুদ্দিনের সমান। শিক্ষা ছিল না অথবা বাইরের দুনিয়ার ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গেও কোনো যোগ ছিল না। কারো।
জালালউদ্দিন সবসময় আমাকে বলত শিক্ষিত লোকজন সম্পর্কে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্পর্কে, সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে, এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের অর্জনগুলো সম্পর্কে। আমাদের সংকীর্ণ পরিবেশের বাইরে একটা সাহসী, নতুন দুনিয়া সম্পর্কে সেই আমাকে সচেতন করে তুলেছিল।
আমার শৈশবের দীনহীন পরিবেশে বই ছিল এক দুর্লভ বস্তু। স্থানীয় অবস্থার তুলনায়, যাহোক, এসটিআর মানিকাম-এর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটা ছিল বেশ বড়ো। এই মানিকাম ছিল একজন সাবেক বিপ্লবী কিংবা উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী। যতটা পারি পড়ার জন্য সে আমাকে উৎসাহ যোগাত এবং প্রায়ই আমি বই ধার নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে যেতাম।