আদর্শ দম্পতি হিসাবে আমার মা-বাবার ছিল ব্যাপক মর্যাদা। আমার মা যে পরিবার থেকে এসেছিলেন সেই পরিবারটি ছিল অনেক বেশি সুখ্যাত, তার পূর্বপুরুষদের একজনকে বৃটিশরা বাহাদুর উপাধি প্রদান করেছিল।
অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চার মধ্যে আমি ছিলাম লম্বা ও সুদর্শন মা-বাবার অনুল্লেখ্য চেহারার খর্বকায় সন্তান। বংশানুক্রমিকভাবে আমাদের যে বাড়িটায় আমরা বাস করতাম সেটা নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯শ শতকের মধ্যভাগে। রামেশ্বরমের মস্ক স্ট্রিটে অবস্থিত ইট আর চুনাপাথরে তৈরি পাকা বাড়িটা ছিল যথেষ্ট বড়ো। আমার কঠোর আত্মসংযমী পিতা অনাবশ্যক আরামআয়েশ ও বিলাসিতা পরিহার করে চলতে অভ্যস্ত ছিলেন। তবে খাদ্য, ওষুধ অথবা বস্ত্রের মতো দরকারি সব বিষয় মেটানো হতো। বস্তুত, আমি বলব যে, আমার শৈশব ছিল নিরাপদ, আবেগ ও বিষয়গত দুদিক থেকেই।
রান্নাঘরের মেঝের ওপর বসে সাধারণত আমি মায়ের সঙ্গে আহার করতাম। আমার সামনে তিনি কলাপাতা রাখতেন, তার ওপর বেড়ে দিতেন ভাত এবং সুগন্ধী সাম্ভার, ঘরে তৈরি এক প্রকার আচার আর এক লোকমা টাটকা নারকেলের চাটনি।
রামেশ্বরম যে কারণে ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের কাছে অতি পবিত্র বলে গণ্য হতো সেই বিখ্যাত শিব মন্দিরটি ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথের দূরত্বে। আমাদের এলাকাটি ছিল ব্যাপকভাবে মুসলমান অধ্যুষিত, তবে কিছু সংখ্যক হিন্দু পরিবারও ছিল, সম্প্রীতির সঙ্গে মুসলমান পড়শিদের সঙ্গে বসবাস করত তারা। আমাদের মহল্লায় অনেককালের পুরোনো একটা মসজিদও ছিল, সন্ধ্যাবেলার প্রার্থনার জন্য আমাকে সেখানে নিয়ে যেতেন বাবা। আরবীতে উচ্চারিত প্রার্থনার অর্থ সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না, কিন্তু আমার পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল যে তা স্রষ্টার কাছে পৌঁছাত। প্রার্থনার পর আমার বাবা কখন বেরিয়ে আসবেন তার অপেক্ষায় বাইরে বসে থাকত নানা ধর্মের লোকজন, তার জন্য অপেক্ষা করত তারা। তাদের অনেকে পানির পাত্র এগিয়ে দিত তার দিকে, বাবা সে সব পাত্রের পানিতে আঙুলের ডগা ডুবিয়ে দোয়া পড়তেন। এই পানি তখন তারা যে যার বাড়িতে নিয়ে যেত অসুস্থ লোকদের জন্য। সুস্থ হয়ে ওঠার পর লোকজন ধন্যবাদ জানাতে আসত আমাদের বাড়িতে সে কথাও আমার মনে পড়ে। আমার বাবা সবসময় হাসতেন আর তাদের বলতেন সর্বদয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে।
রামেশ্বরম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত, পক্ষী লক্ষ্মণা শাস্ত্রী, ছিলেন আমার বাবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই ব্যক্তিদ্বয় সম্পর্কে আমার শৈশবের প্রথম দিককার বর্ণাঢ্য স্মৃতিগুলোর একটা হচ্ছে, নিজ নিজ ঐতিহ্যগত দৃষ্টিকোণ থেকে তারা আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোচনায় মগ্ন থাকতেন। প্রশ্ন করার মতো বড়ো হয়ে ওঠার পর, বাবার কাছে আমি প্রার্থনার প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে জানতে চাই। বাবা আমাকে বলেন, প্রার্থনার মধ্যে রহস্যের কিছুই নেই। বরং লোকজনের মধ্যে পারস্পরিক আধ্যাত্মিক যোগাযোগ সম্ভব হয় প্রার্থনার মাধ্যমে। তিনি আরও বলেন, তুমি যখন প্রার্থনা করো, তখন তুমি তোমার দেহের সীমা অতিক্রম করে যাও, আর পরিণত হও মহাজগতের অংশে, যা ধনদৌলত, বয়স, জাতপাত কিংবা লোভের কোনো বিভাজন মানে না।
.
আমার বাবার সাধ্য ছিল জটিলতম আধ্যাত্মিক ধারণাগুলো সহজ ভাষায়, একেবারে সাদামাটা তামিলে বর্ণনা করার। একবার তিনি আমাকে বলেন, নিজের সময়ে, নিজের জায়গায়, প্রকৃতই নিজে যা, এবং যে স্তরে পৌঁছেছে-ভালো বা খারাপ-তাতে।চিরন্তন সত্ত্বার সমগ্রতার মধ্যে প্রতিটা মানুষই হচ্ছে নির্দিষ্ট উপাদান। সুতরাং অসুবিধা, ভোগান্তি আর সমস্যাসংকট নিয়ে উল্কণ্ঠা কেন? সমস্যা যখন আসবে তখন তোমার ভোগান্তির প্রাসঙ্গিকতা বোঝার চেষ্টা করো। দুঃখদুর্দশা সর্বদা অন্তদৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি করে।
তোমার কাছে যারা সাহায্য ও উপদেশ নিতে আসে তাদের কেন এ কথা বলো না? বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করি। তিনি আমার কাঁধে হাত রাখেন আর সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকান। কিছুক্ষণ তিনি কিছুই বলেন না, যেন তার কথা উপলব্ধি করার সামর্থ্য আমার আছে কিনা বিচার করছিলেন। তারপর তিনি নিচু, গভীর কণ্ঠস্বরে জবাব দিলেন। তার উত্তর অদ্ভুত এক শক্তি আর প্রবল আগ্রহে আমাকে পরিপূর্ণ করে তুলল:
মানুষ যখনই নিজেকে নিঃসঙ্গ দেখতে পায়, তখন স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে সে সঙ্গি খুঁজতে শুরু করে। যখনই তারা কোনো সমস্যায় পড়ে, তখনই কাউকে খুঁজতে থাকে যে তাদের সাহায্য করতে পারবে। যখনই তারা কোনো কানাগলিতে পৌঁছায়। তখনই এমন কাউকে খুঁজতে থাকে যে তাদের। বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পারবে। প্রতিটা পৌনঃপুনিক মানসিক বা শারীরিক যন্ত্রণা, আকুল আকাঙ্ক্ষা, এবং কামনা খুঁজে পায় নিজের বিশেষ সাহায্যকারি। নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে যারা আমার কাছে আসে তাদের ক্ষেত্রে বলতে গেলে আমি একজন মধ্যগ, প্রার্থনার ভেতর দিয়ে অশুভ শক্তির হাত থেকে তাদের নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টার মধ্যে। এটা মোটেও সঠিক পথ নয় এবং এটা কখনও অনুসরণ করা উচিৎ নয়। ভাগ্যের ভীতিতাড়িত দৃশ্য এবং আমাদের আত্মতৃপ্তির শত্রুকে খুঁজে বের করতে যা আমাদের সমর্থ করে সেই দৃশ্যের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা মানুষকে অবশ্যই বুঝতে হবে।