তিলপাত রেঞ্জে যে রাশিয়ান আরএটিও মোটর আমাদের দেখান হয়েছিল সেটা সমর্থ ছিল মোট ২৪৫০০ কেজি-সেকেন্ড ঘাতসহ ৩০০০ কেজি ধাক্কা উৎপাদনে। সেটার ওজন ছিল ২২০ কেজি এবং ইস্পাতের তৈরি একটা ডাবল বেজ প্রোপেল্যান্ট ছিল সেটার। ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও), এইচএএল, ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার) এবং বিমান বাহিনীর সদরদপ্তরের সহযোগিতায় নির্মাণ কাজ করা হয়েছিল স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টারে।
হাতের কাছে পাওয়া সুযোগসুবিধাগুলো বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর, আমি একটা ফাইবারগ্লাস মোটর কেসিং পছন্দ করলাম। একটা কম্পোজিট প্রোপেল্যান্টের অনুকুলে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম। এর সুবিধা ছিল, এটা সর্বোচ্চ ধাক্কা প্রয়োগ করতে পারে এবং পুরোপুরিভাবে এটা ব্যবহারের জন্য দীর্ঘসময় ধরে জ্বলতে পারে। আমি এছাড়াও অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
আরএটিও নিয়ে কাজ করার সময় দুটো অসাধারণ উন্নয়ন প্রক্রিয়া সাধিত হয়েছিল। প্রথমটি হলো দেশের মহাশূন্যে গবেষণার দশ বছরের একটা প্রোফাইল প্রকাশ, প্রস্তুত করেছিলেন অধ্যাপক সারাভাই। এই প্রোফাইল শুধুমাত্র একজন শীর্ষব্যক্তি তার দলের কাজকর্ম তুলে ধরার জন্য তৈরি করেছিলেন তা নয়, এটা ছিল মুক্ত আলোচনার এক থিম পেপার, পরবর্তী সময়ে যা রূপান্তরিত হতো একটা কর্মসূচিতে। বস্তুত, আমার কাছে এটা ছিল এক ব্যক্তির রোমান্টিক ইশতেহার, নিজের দেশের মহাশূন্য গবেষণা কর্মসূচিকে যিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন।
ইনকসপারে যে আইডিয়ার জন্ম হয়েছিল তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল প্রধান পরিকল্পনাটি। এতে আরও যুক্ত ছিল টেলিভিশন ও উন্নয়নমূলক শিক্ষা, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থার রিমোট সেন্সিং ইত্যাদির জন্য কৃত্রিম উপগ্রহের ব্যবহার। এর সঙ্গে আরও যোগ করা হয়েছিল স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকলের উন্নয়ন ও উৎক্ষেপণ।
আগের বছরগুলোয় যেমন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সক্রিয়ভাবে পাওয়া গিয়েছিল, এবারের পরিকল্পনায় স্পষ্টত তা শিথিল হয়ে গেল। এবার আমাদের পুরোপুরি আত্মনির্ভর হতে হলো। পৃথিবীর নিচু কক্ষপথে হালকা ওজনের কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য একটা এসএলভি তৈরির বিষয় পরিকল্পনায় আলোচিত হয়েছিল। এর অর্থ ছিল, ভারতে তৈরি কৃত্রিম উপগ্রহকে গবেষণাগারের মডেল থেকে মহাশূন্যে স্থাপনযোগ্য প্রকৃত আকারে উন্নীত করা এবং অ্যাপোজি, বুস্টার মোটর, মোমেন্টাম হুইল ও সোলার প্যানেল ডেভলপমেন্ট মেকানিজমের মতো বিস্তৃত রেঞ্জের স্পেসক্র্যাফট সাবসিস্টেমের উন্নতিসাধন।
দ্বিতীয় কাজ ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য একটা মিসাইল প্যানেল গঠন করা। নারায়ণন আর আমি সদস্য হিসাবে তাতে অন্তর্ভূক্ত হই। আমাদের নিজেদের দেশে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির আইডিয়া ছিল উত্তেজনাকর, এবং আমরা বিভিন্ন অগ্রসর দেশের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে পর্যালোচনা করে ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত করলাম।
.
ট্যাকটিক্যাল মিসাইল ও স্ট্র্যাটেজিক মিসাইলের মধ্যে পার্থক্য প্রায় সময়ই বেশ মজার। সাধারণভাবে, স্ট্রাটেজিক বলতে বোঝায় যে এই ক্ষেপণাস্ত্র হাজার হাজার কিলোমিটার উড়তে পারবে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে দূরত্বের বদলে লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার বেলায় এই টার্ম ব্যবহৃত হয়। স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল হলো সেসব মিসাইল যা শত্রুর একেবারে হৃৎপিন্ডে আঘাত করতে সক্ষম। ট্যাকটিক্যাল অস্ত্র সেগুলো যা প্রভাব খাটায় যুদ্ধে, আর সে যুদ্ধ হতে পারে স্থলভাগে, সমুদ্রে অথবা আকাশে, অথবা এই তিন ক্ষেত্রেই। এই শ্রেণিকরণ আজকের দিনে নির্বোধ বলে প্রতীয়মান হতে পারে, যেমন একটা উদাহরণ ইউএস এয়ার ফোর্সের ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য টমাহক ব্যবহৃত হয় ট্যাকটিক্যাল শ্রেণিতে যার পাল্লা প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার। সেইসব দিনে স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল সমার্থক ছিল ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইআরবিএম)-এর এবং এর পাল্লা ছিল ১৫০০ নটিক্যাল মাইল বা ২৭৮০ কিলোমিটার এবং আরও সমার্থক ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম)-এর যার পাল্লা ছিল আরও বেশি।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন নারায়ণনের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল গাইডেড মিসাইলের। রাশিয়ান মিসাইল ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রামের উচ্চাভিলাষের অনুরাগী ছিলেন তিনি। ওখানে যখন এটা করা যেতে পারে, তখন এখানে করা যাবে না কেন? মহাশূন্য গবেষণা যেখানে ইতোমধ্যে মিসাইল প্রযুক্তির ভূমি প্রস্তুত করে দিয়েছে। নারায়ণন আমাকে খোঁচা দিতেন।
১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালের দুটো যুদ্ধের তিক্ত শিক্ষা ভারতীয় নেতৃত্বকে সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কৌশলগত অবস্থানসমূহ রক্ষার জন্য ইউএসএসআর থেকে বিপুল পরিমাণ সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল (এসএএম) আনতে হয়েছিল। গ্রুপ ক্যাপ্টেন নারায়ণন দেশে এই মিসাইল তৈরির ব্যাপারে প্রচণ্ড আবেদন করেছিলেন।
মিসাইল প্যানেল নিয়ে যখন আমরা কাজ করছিলাম আরএটিও মোটরের ওপর, তখন নারায়ণন ও আমি ছাত্র ও শিক্ষকের ভূমিকা পালন করছিলাম যেখানে দরকার সেখানেই নিজেদের বদল করে। তিনি রকেট বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী ছিলেন এবং আমি খুব কৌতূহলী ছিলাম এয়ারবোর্ন উইপন সিস্টেম সম্পর্কে। নারায়ণনের মেধা প্রয়োগের শক্তি ও গভীরতা ছিল অনুপ্রেরণাদায়ক। অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে সূর্য ওঠারও আগে তিলপাত রেঞ্জে আমাদের সফরের সেই প্রথম দিনটি থেকে নারায়ণন ব্যস্ত ছিলেন তার আরএটিও মোটর নিয়ে। চাওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় সবকিছু তিনি জোগাড় করে রেখেছিলেন। ৭৫ লাখ রূপি তহবিল গঠন করে ফেলেছিলেন এবং আরও খরচখরচার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতিও তিনি নিয়ে রেখেছিলেন। আপনার যা লাগবে সেটার নাম শুধু আমাকে বলবেন, আমি আপনাকে জিনিসটা এনে দেব, কিন্তু সময় চাইবেন না, তিনি বলেন। সময়ে সময়ে আমি তার অধৈর্য দেখে হাসতাম, আর তাকে পড়ে শোনাতাম টি. এস. এলিয়টের Hollow Men শীর্ষক কবিতার এই লাইনগুলো: