বিজনেস ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত একটা জনপ্রিয় বই ছিল সেটা। আমি বইটা আসলে পড়ছিলাম না। শুধু প্যারাগ্রাফগুলোর ওপর নজর বুলিয়ে যাচ্ছিলাম আর পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছিলাম। অকস্মাৎ বইটার একটা প্যাসেজের ওপর আমার চোখ পড়ল, অংশটা ছিল জর্জ বার্নার্ড শ-এর রচনা থেকে একটা উদ্ধৃতি। ঐ উদ্ধৃতির মর্মকথা ছিল এই যে, বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা নিজেদের মানিয়ে নেয় দুনিয়ার সঙ্গে। কেবল মুষ্টিমেয় কিছু বিচারবুদ্ধিহীন মানুষ নিজেদের সঙ্গে দুনিয়াকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। দুনিয়ার সমস্ত অগ্রগতি নির্ভর করে এই বিচারবুদ্ধিহীন লোকজন ও তাদের উদ্ভাবনামূলক কিন্তু প্রায়ই অনিশ্চিত কাজকর্মের ওপর। বার্নার্ড শ-এর প্যাসেজ থেকে বইটা আমি পড়তে শুরু করেছিলাম। বইটির লেখক শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে উদ্ভাবনা প্রক্রিয়া ও ধারণা যেসব নির্দিষ্ট মিথে বোনা তা বর্ণনা করেছেন। আমি কৌশলগত পরিকল্পনার মিথ সম্পর্কে পড়ি। সাধারণভাবে এটা বিশ্বাস করা হয় যে কৌশলগত এবং প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা বিস্ময় নয় ধরনের ফলাফল প্রচণ্ডভাবে বাড়িয়ে দেয়। লেখকের মতামত ছিল যে একজন প্রকল্প ব্যবস্থাপকের পক্ষে অনিশ্চয়তা নিয়ে জীবনযাপন করতে শেখাটা অত্যাবশ্যকীয়।
হোটেলের লবিতে রাত একটার সময় দুই ঘন্টা পরের একটা সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করাটা নিশ্চয়ই যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব ছিল না, আমার জন্যও না অধ্যাপক সারাভাইয়ের জন্যও না। তবে অধ্যাপক সারাভাই সবসময়ই এ ধরনের কান্ড করে থাকতেন। দেশে তিনি মহাকাশ গবেষণা চালাচ্ছিলেন একটা। তার স্টাফ ছিল কম, কাজ করতে হতো বেশি-তারপরও সাফল্যপূর্ণ আচরণ ছিল তার মধ্যে।
হঠাৎ করে আরেকটা লোকের ব্যাপারে আমি সচেতন হলাম, যিনি এসে আমার বিপরীত দিকে একটা সোফায় বসলেন। ভদ্রলোক বেশ বলিষ্ঠ চেহারার, বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি এবং অত্যন্ত পরিপাটি। পোশাক পরিচ্ছদে সবসময়ই আমি অগোছালো, কিন্তু এই ভদ্রোলোকের পোশাকে দেখা যাচ্ছে আভিজাত্য। তাকে যথেষ্ট সতর্ক দেখা যাচ্ছিল।
লোকটার মধ্যে একটা অদ্ভুত চুম্বকীয় শক্তি ছিল যা আমার উদ্ভাবন বিষয়ক ভাবনার ট্রেনকে লাইনচ্যুত করে দিল। এবং বইটাতে আমি আবার মনোযোগ দেওয়ার আগেই অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ডাক পড়ল। যেখান থেকে বইটা নিয়েছিলাম কাছের সেই সোফার ওপর বইটা রেখে দিলাম। আমার বিপরীত দিকের সোফার ওপর বসা লোকটিকেও যখন অধ্যাপক সারাভাইয়ের কামরায় ডাকা হলো তখন আমি অবাক হলাম। কে এই লোক? আমার উত্তর পেতে বেশি দেরি হলো না। আমরা আসন গ্রহণ করার আগেই অধ্যাপক সারাভাই আমাদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। লোকটি ছিলেন বিমান বাহিনীর সদর দপ্তরের গ্রুপ ক্যাপ্টেন ভি এস নারায়ণন।
অধ্যাপক সারাভাই আমাদের দুজনের জন্য কফির অর্ডার দিলেন এবং সামরিক বিমানের জন্য একটা রকেট-অ্যাসিস্টেড টেক-অফ সিস্টেম (আর এটিও) তৈরির পরিকল্পনা আমাদের সামনে মেলে ধরলেন। এটা আমাদের যুদ্ধ বিমানগুলোকে হিমালয়ের ক্ষুদ্র রানওয়ে থেকে টেক-অফ করতে সাহায্য করবে। অল্প কথার মধ্যে গরম কফি পরিবেশন করা হয়েছিল। অধ্যাপক সারাভাইয়ের স্বভাবসুলভ আচরণের সঙ্গে এর কোনো মিল ছিল না। কিন্তু আমরা কফি শেষ করা মাত্রই অধ্যাপক সারাভাই উঠে দাঁড়ালেন এবং তার সঙ্গে আমাদের যেতে বললেন দিল্লি নগরীর প্রান্তে অবস্থিত তিলপাত রেঞ্জে। আমরা লৰি অতিক্রম করে যাবার সময় আমি কৌতূহলবশত এক নজর তাকালাম সেই সোফাটার দিকে যেটার ওপর বইটা রেখে গিয়েছিলাম। বইটা তখন আর সেখানে ছিল না।
রেঞ্জে পৌঁছাতে প্রায় এক ঘন্টা গাড়ি চালাতে হলো। অধ্যাপক সারাভাই আমাদের দেখালেন একটা রাশিয়ান আরএটিও। রাশিয়া থেকে এই পদ্ধতির মোটর যদি আমি আপনাদের পাইয়ে দিই, তাহলে কি আপনারা আঠারো মাসে এটা করতে পারবেন? অধ্যাপক সারাভাই আমাদের কাছে জানতে চাইলেন। হ্যাঁ, আমরা পারব। গ্রুপ ক্যাপ্টেন ভিএস নারায়ণন ও আমি প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলাম। অধ্যাপক সারাভাইয়ের মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, তাতে প্রতিফলিত হচ্ছিল আমাদের আবিষ্টতা।
হোটেল অশোকায় আমাদের ফিরিয়ে আনার পর অধ্যাপক সারাভাই ব্রেকফাস্ট মিটিং-এ চলে গেলেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। সেই সন্ধ্যায় আমার নেতৃত্বে ভারতীয় সামরিক বিমানের শর্ট রানওয়েতে উডডয়নের জন্য একটা যন্ত্র তৈরির খবর প্রচার করা হলো। অসংখ্য আবেগে আমার মন পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সুখ, কৃতজ্ঞতা, পরিপূর্ণতার এক অনুভূতি এবং উনবিংশ শতাব্দীর স্বল্পপরিচিত একজন কবির লেখা একটা কবিতার এই লাইনগুলো আমার মনে ভেসে উঠছিল:
For all your days prepare
And meet them ever alike
When you are the anvil, bear
When you are the hammer, strike.
আরএটিও মোটর বিমানে যুক্ত করা হয়েছিল টেক-অফ রানের সময় নির্দিষ্ট অপারেটিং কন্ডিশনে অতিরিক্ত ধাক্কা প্রক্ষেপণের জন্য এবং সেই কন্ডিশনগুলো ছিল যেমন আংশিকভাবে বোমা-ধ্বস্ত রানওয়ে, হাই অ্যাল্টিচিউড এয়ারফিল্ড, অতিরিক্ত লোড, অথবা অত্যন্ত চড়া পরিবেষ্টক তাপমাত্রা। এয়ার ফোর্সের এস২২ ও এইচএফ ২৪ বিমানের জন্য বেশ কিছু আরএটিও অত্যন্ত প্রয়োজন হয়েছিল।