.
আমি প্রায় সময় কাহলিল জিবরানের রচনা পড়ি। আর সবসময় তার লেখায় আবিষ্কার করি জ্ঞানের কথা। ভালোবাসা ছাড়া যে রুটি তৈরি করা হয় সে রুটি তিক্ত রুটি, যা একজন মানুষের ক্ষুধা অর্ধেক মেটাতে পারে। যারা হৃদয় ঢেলে কাজ করতে পারে না তারা সাফল্য অর্জন করে আধাআধি যার থেকে সৃষ্টি হয় তিক্ততা। তুমি যদি একজন লেখক হও অথচ মনের গোপন বাসনা থাকে একজন ডাক্তার বা আইনজ্ঞ হবার, তাহলে তোমার লেখা পাঠকদের পড়ার ক্ষুধা মেটাবে অর্ধেকটা, পুরোপুরি নয়। তুমি যদি শিক্ষক হও যে কিনা ব্যবসায়ী হতে চাও, তাহলে তোমার পাঠদান তোমার ছাত্রদের জ্ঞানের তৃষ্ণা পুরোপুরি নিবারণ করতে পারবে না। তুমি যদি এমন একজন বিজ্ঞানী হও যে বিজ্ঞানকে অপছন্দ করে, তাহলে তোমার কাজ অর্ধেক প্রয়োজন মেটাবে তোমার মিশনের। ব্যক্তিগত সুখহীনতা ও ফলাফল অর্জনে ব্যর্থতা নতুন নয়। কিন্তু অধ্যাপক ওড়া ও সুধাকরের উদাহরণ যখন সামনে আসে তখন অন্যরকম ভাবনা আসাটাই স্বাভাবিক। নিজেদের কাজের মধ্যে তারা যোগ করেছিলেন তাদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, আর হয়তো তাদের হৃদয়ের স্ফটিক-স্বচ্ছস্বপ্ন। নিজেদের কাজের সঙ্গে তারা এতটাই আবেগপ্রবণভাবে যুক্ত ছিলেন যে, তাদের চেষ্টায় কোনো সাফল্য না এলে তারা ভীষণ বেদনার্ত হতেন।
অধ্যাপক ওড়া ছিলেন জাপানের ইন্সটিটিউট অব স্পেস অ্যান্ড অ্যারোনটিক্যাল সায়েন্সেস (আইএসএএস)-এর এক্স-রে পেলোড বিজ্ঞানী। উঁচু ব্যক্তিত্ব আর উজ্জ্বল দ্যুতিময় চোখের মানুষ হিসাবে তাকে আমার মনে আছে। কাজের প্রতি তার উৎসর্গকৃত মনোভাব ছিল দৃষ্টান্তমূলক। আইএসএএস থেকে তিনি এক্সরে পেলোড সৃর্জন আনতেন, অধ্যাপক ইউআর রাও-এর তৈরি এক্স-রে পেলোডসহ ওই পেলোড় আমার দল রোহিনী রকেটের নাকের ডগায় বসিয়ে দেওয়ার জন্য প্রকৌশলগত কাজকর্ম করত। ভূ-পৃষ্ট থেকে ১৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় সেই নাকের ডগা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত ইলেকট্রনিক টাইমারের সাহায্যে পাইরোস বিস্ফোরণে। এভাবে মহাশূন্যে এক্স-রে সেন্সর স্থাপন করা হতো চাহিদা অনুযায়ী নক্ষত্রমন্ডলী থেকে নির্গত বস্তুর তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। অধ্যাপক ওডা ও অধ্যাপক রাও একত্রে ছিলেন মেধা ও আত্মত্যাগের এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত, সচরাচর দেখা যায় না। একদিন আমি যখন আমার টাইমার ডিভাইস নিয়ে অধ্যাপক ওভার পেলোডের জন্য একীভবনের কাজ করছিলাম, তখন তিনি, জাপান থেকে আনা টাইমার ব্যবহারের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমার কাছে ওগুলো মনে হলো দুর্বল, কিন্তু অধ্যাপক ও অনড় হয়ে রইলেন তার জায়গায় যে ভারতীয় টাইমারের বদলে জাপানী টাইমার ব্যবহার করতে হবে। আমি তার পরামর্শ মেনে নিয়ে টাইমার বদল করলাম। রকেট চমৎকারভাবে আকাশে উঠল আর নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছাল। কিন্তু টেলিমেট্রি সিগনাল থেকে জানা গেল, টাইমার যথাযথভাবে কাজ না করায় মিশন ব্যর্থ হয়েছে। অধ্যাপক ওড়া এতটাই বিষণ্ণ হয়েছিলেন যে তার চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। আমি হতবাক হয়ে পড়েছিলাম অধ্যাপক ওড়ার এই আবেগপূর্ণতা দেখে। তিনি স্পষ্টত হৃদয়-মন সঁপে দিয়েছিলেন তার কাজে।
পেলোড প্রিপারেশন ল্যাবরেটরিতে সুধাকর ছিল আমার সহকর্মী। উৎক্ষেপণপূর্ব শিডিউলের অংশ অনুযায়ী আমরা বিপদজনক সোডিয়াম ও থামাইট মিশ্রণ পূর্ণ করছিলাম ও দূরনিয়ন্ত্রণ উপায়ে চাপ প্রয়োগ করছিলাম। চিরাচরিতভাবে থুম্বার দিনটা ছিল গরম ও আর্দ্র। এ ধরনের ছয়টি অপারেশনের পর সুধাকর ও আমি মিশ্রণ যথাযথ পূর্ণ হয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পেলোড রুমে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ তার কপাল থেকে এক ফোঁটা ঘাম পড়ল সোডিয়ামে। ফলাফল, কী হচ্ছে আমরা বুঝে ওঠার আগেই, প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে কামরাটা কেঁপে উঠল। পরবর্তী কয়েক মুহূর্ত একেবারে অসাড় অবস্থাতেই কাটল। আমি বুঝতে পারিনি কী করতে হবে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল, আর পানি দিয়ে সোডিয়ামের আগুন নেভান যেত না। এই অবস্থার মধ্যেও সুধাকর কিন্তু চেতনা হারায়নি। খালি হাতেই সে জানলার কাঁচ ভেঙে ফেলল আর আক্ষরিক অর্থেই আমাকে জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে নিজেও লাফিয়ে পড়ল। আমি কৃতজ্ঞতায় সুধাকরের হাত স্পর্শ করলাম। তার হাত থেকে তখন রক্ত ঝরছিল, যন্ত্রণার মধ্যেও সে হাসছিল। অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কারণে সুধাকরকে কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
.
টিইআরএলএসে আমি জড়িত ছিলাম রকেট তৈরির তৎপরতা, পেলোড অ্যাসেম্বলি, টেস্টিং এবং ক্রমোন্নতি ইত্যাদি ছাড়াও পেলোড হাউজিং ও জেটিসনেবল নোজ কোন-এর মতো সাবসিস্টেম নির্মাণের কাজেও। স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে নোজ কোন নিয়ে আমার কাজ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল কম্পোজিট ম্যাটারিয়ালের ক্ষেত্রে।
এটা খুব কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার যে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে যে সব ধনুক পাওয়া গেছে তা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, ভারতীয়রা কাঠ, পেশীতন্তু ও শিং দিয়ে তৈরি কম্পোজিট (যৌগিক) ধনুক ব্যবহার করত একাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, মধ্যযুগীয় ইউরোপে ওই ধরনের ধনুক তৈরির আরও অন্তত ৫০০ বছর আগে। কম্পোজিটের বহুমুখ-কর্মশক্তি সম্পন্নতা আমাকে চমৎকৃত করেছিল। এই দিক থেকে যে এতে থাকে অত্যন্ত আকাঙ্খিত গঠনগত, থার্মাল, বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক ও যান্ত্রিক সমৃদ্ধি। মানুষের তৈরি এই বস্তুতে আমি এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলাম যে তাড়াহুড়ো করে এক রাতের মধ্যে এ বিষয়ে সবকিছু জানতে চেয়েছিলাম। এর সঙ্গে সম্পর্কিত সব লেখা আমি পড়তাম যা পাওয়া যেত হাতের কাছে। আমি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম গ্লাস ও কার্বন ফাইবার রিইনফোর্সড পাস্টিক (এফআরপি) কম্পোজিট সম্পর্কে।