১৯৯১ সালের ১৫ অক্টোবর আমার বয়স হয়েছিল ষাট বছর। আমি অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সামাজিক পরিষেবার ক্ষেত্রে নিজের কর্তব্য বলে বিবেচিত বিষয়গুলো পূরণ করার উদ্দেশ্যে। তার বদলে একসঙ্গে দুটো ব্যাপার ঘটল। প্রথমত, আরও তিন বছর সরকারি চাকরি করতে সম্মত হলাম, এবং দ্বিতীয়ত, তরুণ সহকর্মী অরুণ তিওয়ারি অনুরোধ করলেন তাকে আমার স্মৃতিকথা শোনানোর জন্য, যাতে সেগুলো তিনি রেকর্ড করে নিতে পারেন। ১৯৮২ সাল থেকে আমার গবেষণাগারে কাজ করছিলেন তিনি, কিন্তু ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগে খুব ভালোভাবে তাকে আমি চিনতাম না সেই সময় তাকে আমি হায়দারাবাদের নিজামস ইন্সটিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর ইনটেনসিভ করোনারি কেয়ার ইউনিটে দেখতে গিয়েছিলাম। তার বয়স ছিল বড়োজোর ৩২ বছর, কিন্তু জীবনের জন্য দারুণ লড়াই করছিলেন। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি যা চান আমার তেমন কোনো কিছু করার আছে কিনা। আমাকে আপনার আশীর্বাদ দিন, স্যার, তিনি বললেন, যাতে করে আমি একটু লম্বা জীবন পাই আর আপনার একটা প্রকল্প অন্তত সম্পূর্ণ করতে পারি। এই তরুণের আত্মনিবেদন আমাকে আলোড়িত করেছিল। আমি সারারাত তার রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করেছিলাম। প্রভু আমার প্রার্থনায় সাড়া দিয়েছিলেন। তিওয়ারি কাজে ফিরে এলেন এক মাসের মধ্যে। তিন বছরের সংক্ষিপ্ত পরিসরের মধ্যে খন্ডিত অংশ থেকে আকাশ মিসাইল ফেম গড়ে তুলতে অপূর্ব কাজ করেছিলেন তিনি। তারপর তিনি আমার স্মৃতিকথা নিতে শুরু করলেন। ধৈর্যের সঙ্গে টুকরো ও খন্ড অংশগুলো একত্রিত করে বর্ণনার ধারাবাহিকতায় রূপ দিলেন। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি হাতড়ে সে সব কবিতার টুকরো বের করে আনলেন যেগুলো পড়ার সময় আমি চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলাম, আর তা যোগ করে দিলেন এই বইয়ে।
এ বই, আমি মন করি, শুধুই আমার ব্যক্তিগত অর্জন ও দুঃখদুর্দশার কাহিনি নয়, বরং আধুনিক ভারতে বিজ্ঞানের সাফল্য আর বাধাবিপত্তিরও কাহিনি, যে ভারত প্রযুক্তিগত অগ্রগামিতায় নিজেকে যুক্ত করার সংগ্রাম চালাচ্ছে। এ কাহিনি জাতীয় উচ্চাকাঙ্খা ও সমবায়ী প্রচেষ্টার। আর আমি যেভাবে দেখি, ভারতের বৈজ্ঞানিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য অনুসন্ধানের গাথা এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আমাদের কালের এক রূপক কাহিনি।
এই সুন্দর গ্রহের প্রতিটা প্রাণীকে খোদা সৃষ্টি করেছেন এক একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের জন্য। জীবনে যা কিছু আমি আর্জন করেছি তা তারই কৃপায়, আর তা তারই ইচ্ছার প্রকাশ। তিনি কয়েকজন অনন্য সাধারণ শিক্ষক ও সহকর্মীর মাধ্যমে আমার ওপর নাজিল করেছেন অশেষ রহমত, আর আমি এই চমৎকার ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে উর্ধে তুলে ধরছি তার মহিমা। কালাম নামে একটা ক্ষুদ্র মানুষের মাধ্যমে করা এসব রকেট আর মিসাইল আসলে তারই কাজ। ভারতের কোটি কোটি মানুষকে কখনও ক্ষুদ্র আর অসহায়বোধ না করতে বলার জন্যই। আমরা প্রত্যেকেই ভেতরে ঐশ্বরিক আগুন নিয়ে জন্মাই। আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ এই আগুনের ডানা যুক্ত করার এবং এর মঙ্গলময়তার আলোয় জগৎ পূর্ণ করা।
খোদা আপনাদের মঙ্গল করুন!
এ পি জে আবদুল কালাম।
.
উইংস অব ফায়ার অনুবাদ প্রসঙ্গে
অরুণ তিওয়ারি এক দশকেরও বেশি সময় ড. এ পি জে আবদুল কালামের অধীনে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছেন। ফলে এ বই লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করায় আবদুল কালামের সহযোগী হিসাবে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত। অরুণ তিওয়ারির মাধ্যমে আবদুল কালাম ও প্রকাশনা সংস্থা ইউনিভার্সিটিজ প্রেস-এর অনুমতি সাপেক্ষে উইংস অব ফায়ার-এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হলো। বইটির এই বাংলাদেশ সংস্করণ অনুবাদকের অনুকূলে কপিরাইটকৃত। সুতরাং অন্য অনুবাদকের নাম ব্যবহার করে এই বইটি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করলে তা অবৈধ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়টির ওপর আমি গুরুত্ব আরোপ করতে চাই আরও একটি কারণে। আমার প্রকাশক মনির হোসেন পিন্টু এই বই থেকে কোনো মুনাফা অর্জন করছেন না, আমিও কোনো রয়াল্টি নিচ্ছি না। প্রকাশক ও অনুবাদক হিসাবে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছি যে, এই বই বিক্রি থেকে অর্জিত সমস্ত অর্থ ব্যয় করা হবে ঢাকা মহানগরীর অনাথ পথশিশুদের কল্যাণে। এই শিশুদের জন্যে আরও বড়ো আকারে কল্যাণকর কিছু করার দিকে এটা হচ্ছে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। এ উদ্দেশ্যেই ১৫ অক্টোবর আবদুল কালামের ৭২ তম জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বইটি প্রকাশ করা হলো। আমি আশাবাদী, এ ব্যাপারে পাঠকেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন।
প্রমিত হোসেন
অক্টোবর ২০০২
১. উদ্গম [১৯৩১-১৯৬৩]
১. উদ্গম [১৯৩১-১৯৬৩]
এই পৃথিবী তার, ওই বিস্তীর্ণ ও সীমাহীন আকাশের তিনিই মালিক; তারই মধ্যে আছে মহাসাগর, আবার তিনি বিরাজ করেন ক্ষুদ্র জলাধারে।
অথর্ব বেদ
পরিচ্ছেদ ৪, স্তোত্র ১৬
.
১
পূর্বতন মাদ্রাজ রাজ্যের দ্বীপশহর রামেশ্বরমের একটি মধ্যবিত্ত তামিল পরিবারে আমার জন্ম। আমার বাবা, জয়নুলাবদিন, খুব বেশি দূর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করতেন পারেননি। খুব বেশি ধনসম্পদও তার ছিল না। এসব অসুবিধা সত্ত্বেও তার ছিল বিপুল সহজাত জ্ঞান ও আত্মার খাঁটি বদান্যতা। আমার মা, আশিয়াম্মার। তার মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন এক আদর্শ সহধর্মীনি। মা প্রতিদিন যতজন লোককে খাওয়াতেন তাদের সঠিক সংখ্যা আমি মনে করতে পারব না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আমাদের পরিবারের মোট সদস্যের চেয়ে তাদের সংখ্যা হতো অনেক অনেক বেশি।