অধ্যাপক সারাভাইয়ের আশাবাদ ছিল অত্যন্ত সংক্রামক। থুম্বায় তার আগমণের নির্দিষ্ট খবর লোকজনকে যেন বৈদ্যুতিন করে তুলত আর সমস্ত গবেষণাগার, ওয়ার্কশপ ও ডিজাইন অফিস গুঞ্জন করতে থাকত অবিরাম কর্মতৎপরতায়। লোকেরা দৃশ্যত চব্বিশ ঘন্টা কাজ করত। কারণ তারা অধ্যাপক সারাভাইকে নতুন কিছু দেখাতে চাইত স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এমনকিছু যা আগে আর কখনও করা হয়নি আমাদের দেশে-তা হোক একটা নতুন ডিজাইন কিংবা ফেব্রিকেশনের একটা নতুন পদ্ধতি অথবা এমনকি অদ্ভুত কোনো প্রশাসনিক প্রসিডিওর। অধ্যাপক সারাভাই প্রায়ই একক কোনো ব্যক্তি বা কোনো দলকে একাধারে নানাবিধ কাজ দিতেন। প্রথম দিকে মনে হতো ওসব কাজ পরস্পরের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্কহীন, পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যেত ওগুলো পরস্পরের সঙ্গে গভীর সম্পর্কযুক্ত। অধ্যাপক সারাভাই যখন স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (এসএলভি) সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি আমাকে বললেন, প্রায় এক নিঃশ্বাসে, সামরিক বিমানের জন্য রকেট-অ্যাসিস্টেড টেক-অফ সিস্টেম (আরএটিও) বিষয়ে আমি যেন পড়াশোনা করি। এই মহান দ্রষ্টার মনে ছাড়া এ দুটো বিষয়ের স্পষ্ট কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি জানতাম যে আমাকে সতর্ক থাকতে হবে আর আমার উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে এবং আগে বা পরে চ্যালেঞ্জিং কোনো কাজ করার সুযোগ আমার গবেষণাগারে প্রবেশ করবে।
অধ্যাপক সারাভাই তরুণদের অভিনব ভাবনা বের করে আনার ও তা তাদের মনে আঁকার চেষ্টা করতেন। তার এমন জ্ঞান ও বিচারবোধ ছিল যা দিয়ে তিনি কোনো ভালো কিছু হয়ে থাকলে উপলব্ধি করতে পারতেন। তবে এটাও জানতেন কখন থামতে হবে। আমার মতে, তিনি ছিলন একজন আদর্শ নিরীক্ষক ও উদ্ভাবক। আমাদের সামনে যখন কাজের বিকল্প কোর্স থাকত, যার ফলাফল সম্পর্কে আগেই কিছু বলা ছিল শক্ত, তখন তার সামাধান বের করে দিতেন অধ্যাপক সারাভাই। ১৯৬৩ সালে ইনকসপারে এই ছিল পরিস্থিতি। একদল তরুণ, অনভিজ্ঞ, কিন্তু উদ্যমী ও উৎসাহী ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছিল সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আর নির্দিষ্টভাবে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠার কাজ। এটা ছিল আস্থার দ্বারা নেতৃত্বের এক বিশাল উদাহরণ।
.
রকেট উৎক্ষেপণ এলাকাটি পরে বিকশিত হলো থুম্বা ইকুয়ারিয়াল রকেট লঞ্চ স্টেশন (টিইআরএলএস) নামে। ফ্রান্স, ইউএসএ ও ইউএসএসআর-এর সক্রিয় সহযোগিতায় টিইআরএলএস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভারতীয় মহাকাশ কর্মসূচির নেতা, অধ্যাপক বিক্রম সারাভাই চ্যালেঞ্জের পূর্ণ সংশ্লেষ উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা এড়িয়ে যাননি। ইনকসপার যে দিন গঠন করা হয় ঠিক সেদিন থেকে তিনি সচেতন ছিলেন একটা অখণ্ড জাতীয় মহাকাশ কর্মসূচি আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। সেই সঙ্গে রকেট তৈরির সাজসরঞ্জাম ও উৎক্ষেপণ স্থাপনার উন্নয়ন।
এই ব্যাপারটা মনে রেখে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নভিত্তিক ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আহমেদাবাদে ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি এবং স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টারে যেসব বিষয় নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করা হয় সেগুলো ছিল রকেট ফুয়েল, প্রপালসন সিস্টেম, অ্যারোনটিকস, অ্যারোস্পেস ম্যাটেরিয়াল, অ্যাডভান্সড ফেব্রিকেশন টেকনিক, রকেট মটর ইট্রুমেন্টেশন, কন্ট্রোল অ্যান্ড গাইডেন্স সিস্টেম, টেলিমেট্রি, ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং মহাশূন্যে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। ঘটনা পরম্পরায় বছরজুড়ে এই গবেষণাগার সৃষ্টি করেছে বিপুলসংখ্যক যোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানী।
ভারতীয় অ্যারোস্পেস কর্মসূচির সত্যিকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল রোহিনী সাউন্ডিং রকেট (আরএসআর) প্রোগ্রাম থেকে। একটা ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটা সাউন্ডিং রকেটকে স্বতন্ত্র করে কোন বিষয়টা? প্রকৃতপক্ষে এগুলো তিনটি আলাদা ধরনের রকেট। সাউন্ডিং রকেট সাধারণভাবে ব্যবহার করা হয় পৃথিবীর নিকটবর্তী পরিবেশ অনুসন্ধানের কাজে, অ্যাটমসফিয়ারের ওপরের অঞ্চলসহ। উচ্চতার একটা সীমা পর্যন্ত এগুলো বিভিন্ন প্রকার বৈজ্ঞানিক পেলোড নিয়ে যেতে পারে, তবে পেলোডের নিজ অক্ষে ঘুর্ণনের জন্য প্রয়োজনীয় চূড়ান্ত গতি প্রয়োগ করতে পারে না। অন্যদিকে লঞ্চ ভেহিকল এমনভাবে নকশা করা হয় যা কৃত্রিম উপগ্রহ বা প্রযুক্তিগত পেলোডকে নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের বেগসহ ইনজেক্ট করতে পারে। একটা লঞ্চ ভেহিকলের শেষ স্তর প্রয়োজনীয় বেগ দিয়ে থাকে কৃত্রিম উপগ্রহে নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের জন্য। এটা একটা জটিল কার্যক্রম যাতে প্রয়োজন হয় গাইডেন্স ও কন্ট্রোল সিস্টেম। একটা ক্ষেপণাস্ত্র, একই পরিবারের সদস্য হলেও, আরও বেশি জটিল পদ্ধতির অন্তর্গত। বিশাল টার্মিনাল ভেলোসিটি ও অনবোর্ড গাইডেন্স অ্যান্ড কন্ট্রোলের সঙ্গে এতে আরও যোগ করতে হয় লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার সামর্থ্য। লক্ষ্যবস্তু যখন থাকে দ্রুতগতিতে ধাবমান আর কৌশলে অভিযান চালানোয় পারদর্শী, তখন ক্ষেপণাস্ত্রেও যোগ করতে হয় টার্গেট-ট্র্যাকিং ফাংশন।
আরএসআর কর্মসূচি ছিল ভারতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সাউন্ডিং রকেট উন্নয়ন ও ফেব্রিকেশন। এই কর্মসূচির অধীনে অপারেশনাল সাউন্ডিং রকেটের একটা পরিবার প্রস্তুত করা হয়েছিল। এসব রকেটের ছিল বিস্তৃত রেঞ্জিং সামর্থ্য, আর আজ পর্যন্ত কয়েক শ রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রকার বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক গবেষণা কাজে।