আমার মা একবার পবিত্র কিতাব থেকে একটা ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করার পর, আদমকে সেজদা করতে বললেন ফেরেশতাদের। সবাই আদমের সামনে সেজদা করল, কিন্তু ইবলিস, বা শয়তান, তা করল না। তুমি কেন সেজদা করলে না? আল্লাহ প্রশ্ন করলেন। আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন আর আদমকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে। তাতে করে আমি কি আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই? শয়তান তর্ক করল। আল্লাহ বললেন, বেহেশত থেকে দূর হয়ে যা! তোর উদ্ধত অহংকারের জায়গা নয় এটা। শয়তান আল্লাহর কথা মেনে নিল, তবে আদমের জন্যও একই ভাগ্য বরণের অভিশম্পাত দেওয়ার আগে নয়। একটা নিষিদ্ধ ফল খেয়ে নির্দেশ লংঘনকারীতে পরিণত হলেন আদম, সুতরাং অবিলম্বে অভিশম্পাত লেগে গেল। আল্লাহ বললেন, এই স্থান থেকে দূর হও, আর তোমার বংশধররা যেন সন্দেহ আর অবিশ্বাসের মধ্যে জীবনযাপন করে।
ভারতীয় সংগঠনগুলোর জীবনকে যা কঠিন করে তুলেছে তা হলো এই উদ্ধত অহংকার। এ কারণে আমরা আমাদের কনিষ্ঠদের কথা, অধীনস্তদের কথা বা নিম্নবর্গের মানুষদের কথা শুনি না। যদি কোনো ব্যক্তির ওপর তুমি পীড়ন চালাও, তাহলে তার কাছ থেকে ভালো কিছুর ফলাফল তুমি আশা করতে পার না। তুমি তাকে নির্যাতন করলেও সে সৃষ্টিশীল ব্যক্তি হয়ে উঠবে তা আশা করা যায় না। বলিষ্ঠতা ও রূঢ়তা, শক্তিশালী নেতৃত্ব ও দুর্বলের ওপর নির্মম নিপীড়ন, শৃঙ্খলা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা ইত্যাদির মধ্যে যে রেখা আছে তা ভালো কথা, কিন্তু সে রেখা টানতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে আজ হিরো ও জিরোর মধ্যে লক্ষণীয় রেখা টানা হয়েছে। এর একদিকে রয়েছে মুষ্টিমেয় কয়েকশ হিরো আর অন্যদিকে নয়শ পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ। এ পরিস্থিতি বদলাতে হবে।
নাসা থেকে আমার ফিরে আসার পর পরই, ভারতের প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ করা হলো ২১ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে। রকেটটার নাম ছিল নাইক-অ্যাপাচি, তৈরি করা হয়েছিল নাসায়। রকেটটা অ্যাসেম্বল করা হয়েছিল গির্জা ভবনে, যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। রকেটটা পরিবহনের জন্য একমাত্র সুলভ যে ইকুইপমেন্ট পাওয়া গেল সেটা ছিল একটা ট্রাক এবং একটা হস্তচালিত হাইড্রলিক ক্রেন। অ্যাসেম্বল করা রকেটটা গির্জা ভবন থেকে উৎক্ষেপণ মঞ্চে তুলতে হয়েছিল ট্রাকের সাহায্যে। ক্রেন দিয়ে যখন রকেটটা উত্তোলন করা হয়েছে এবং লঞ্চারে স্থাপন করার উপক্রম করা হয়েছে, তখনই সেটা কাত হতে শুরু করল, ক্রেনের হাইড্রলিক সিস্টেমে একটা ছিদ্র হবার ইঙ্গিত দিল। উৎক্ষেপণ সময় সন্ধ্যা ৬টার একেবারে কাছাকাছি আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম, কাজেই ক্রেন মেরামতের কোনো সুযোগ আমাদের ছিল না। সৌভাগ্যবশত ছিদ্রটা তত বড়োও ছিল না আর রকেটটা হাত লাগিয়ে তুলে ফেলতে আমরা সক্ষম হলাম, আমাদের সম্মিলিত পেশীশক্তি ব্যবহার করে শেষ পর্যন্ত লঞ্চারের ওপর সেটা স্থাপন করলাম।
নাইক-অ্যাপাচি উৎক্ষেপণে আমি ছিলাম রকেট একীভবন ও নিরাপত্তার দায়িত্বে। আমার দুজন সহকর্মী যারা এই উৎক্ষেপণে অত্যন্ত সক্রিয় ও কঠিন ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা হলেন ডি ঈশ্বরদাস ও আর আরাভামুন। রকেট অ্যাসেম্বলি ও উৎক্ষেপণ ব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ঈশ্বরদাস। আরাভামুনকে আমরা ডাকতাম ডান বলে, তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাডার, টেলিমেট্রি ও গ্রাউন্ড সাপোর্টের। উৎক্ষেপণটা হয়েছিল মসৃণ আর সমস্যামুক্ত। আমরা অসাধারণ ফ্লাইট ডাটা পেয়েছিলাম আর ফিরে এসেছিলাম গৌরব ও সংসাধনের অনুভূতি নিয়ে।
.
পরের সন্ধ্যায় আমরা আয়েশ করছি ডিনার টেবিলে, ঠিক তখনই খবর পেলাম টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাসে নিহত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। আমরা আতঙ্কিত হলাম। কেনেডির শাসনামলটা ছিল আমেরিকায় অসাধারণ একটা যুগ। ১৯৬২ সালের মিসাইল সংকটে কেনেডির তৎপরতার বিষয় খুব আগ্রহ নিয়ে আমি পড়তাম। কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইল সাইট নির্মাণ করেছিল, যেখান থেকে আমেরিকান শহরগুলোর ওপর হামলা চালানো সম্ভব হতো। তিনি একটা ব্লকেড বা ক্যায়ারেন্টিন আরোপ করলেন, কিউবায় কোনো আক্রমণাত্মক মিসাইল স্থাপনে বাধা দিলেন। আমেরিকা আরও হুমকি দিল যে, কিউবা থেকে পশ্চিমা যে কোনো দেশের ওপর সোভিয়েত পারমাণবিক হামলা হলে সে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর পাল্টা হামলা চালাবে। চৌদ্দ দিনের টান টান নাটকের পর সংকট নিরসন করলেন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট খুশ্চেভ, তিনি কিউবার স্থাপনা অপসারণ ও মিসাইলগুলো রাশিয়ায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন।
পরদিন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অধ্যাপক সারাভাইয়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা ছিল আমাদের। ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তিনি নতুন এক ফ্রন্টিয়ার সৃষ্টি করছিলেন। এক নতুন প্রজন্ম, ৩০ ও ৪০-এর দশকের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী, সবাই স্পন্দিত হচ্ছিল অভূতপূর্ব এক গতিশীলতায়। ইনকাঁপারে আমাদের সবচেয়ে বড়ো যোগ্যতা ছিল আমাদের ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নয়, আমাদের সামর্থ্যের ওপর অধ্যাপক সারাভাইয়ের বিশ্বাস। নাইক-অ্যাপাচির সফল উৎক্ষেপণের পর, একটা ইন্ডিয়ান স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল নির্মাণের যে স্বপ্ন, তার ছিল সেই স্বপ্ন তিনি আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন।