ড. ডেরেইরা ১৯৬২ সালে ছিলেন ত্রিবান্দ্রামের বিশপ। শীঘ্রই সেন্ট্রাল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট (সিপিডব্লিউডি)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরডি জন পুরো এলাকা রূপান্তরিত করে ফেললেন। সেন্ট মেরি ম্যাগডালিন গির্জাটি হলো থুম্বা স্পেস সেন্টারের প্রথম অফিস। প্রার্থনার কামরাটা ছিল আমার প্রথম গবেষণাগার, বিশপের কক্ষটা ছিল আমার ডিজাইন ও ড্রয়িং-এর অফিস। আজকের দিন পর্যন্তও গির্জাটাকে রাখা হয়েছে পূর্ণ মহিমায় এবং বর্তমানে এটাকে বানান হয়েছে ভারতীয় মহাকাশ জাদুঘর।
এসবের পরপরই আমাকে আমেরিকায় যেতে বলা হলো সফলভাবে রকেট উৎক্ষেপণ কলাকৌশল বিষয়ক ছয় মাসের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য, দ্য ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)-এর ওয়ার্ক সেন্টারে। দেশের বাইরে যাবার আগে আমি কয়েক দিনের অবকাশ নিয়ে রামেশ্বরমে গেলাম। আমার যে সুযোগ এসেছে তা শুনে আমার বাবা দারুণ খুশি হলেন। তিনি আমাকে মসজিদে নিয়ে গেলেন এবং শুকরানার জন্য বিশেষ নামাজ পড়লেন। আমি অনুভব করলাম স্রষ্টার ক্ষমতা আমার বাবার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আমার মধ্যে এবং আবার ফিরে যাচ্ছে স্রষ্টার কাছে; আমরা প্রার্থনার মধ্যে পুরোপুরি আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রার্থনার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, আমার ধারণা, সৃষ্টিশীল আইডিয়ার প্রতি উদ্দীপনা জাগান। মনের ভেতরে রয়েছে সফল জীবনের জন্য প্রত্যাশিত সকল ক্ষমতা। চেতনায় উপস্থিত আছে আইডিয়া, যখন তা সুযোগ পায় বেড়ে ওঠার ও আকার নেওয়ার, তখন তা নিয়ে যেতে পারে সফলতায়। খোদা, আমাদের স্রষ্টা, বিপুল শক্তি ও সামর্থ্য জমা রেখেছেন আমাদের চেতনায় ও ব্যক্তিত্বে। প্রার্থনা আমাদের সাহায্য করে এসব শক্তি উৎসারিত করতে।
আহমেদ জালালুদ্দিন ও শামসুদ্দিন আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল বোম্বাই বিমান বন্দরে। বোম্বাইয়ের মতো বড়ো কোনো শহরে এটা ছিল তাদের প্রথম আগমন, ঠিক আমি নিজে যেমন প্রথমবারের মতো নিউ ইয়র্কের ন্যায় কোনো মেগা সিটিতে যাচ্ছি। জালালুদ্দিন ও শামসুদ্দিন ছিল আত্মনির্ভর, ইতিবাচক এবং আশাবাদী মানুষ। নিজেদের কাজ তারা নিয়েছিল সাফল্যের নিশ্চয়তাসহ। এই দুই ব্যক্তির কাছ থেকেই আমি আমার মনের সৃষ্টিশীল ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম। আমি আবেগ ধারণ করতে পারি না। আর বুঝতে পারি অশ্রুতে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। জালালুদ্দিন তখন বলল, আজাদ, আমরা সবসময় তোমাকে ভালোবেসেছি, আর আমরা তোমাকে বিশ্বাস করেছি। আমরা সবসময় তোমাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করব। আমার সামর্থ্যের প্রতি তাদের আস্থার এই বিশুদ্ধতা আমার শেষ প্রতিরোধ ভেঙে দেয়, আর আমার গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রু।
২. সৃজন [১৯৬৩–১৯৮০]
২. সৃজন (১৯৬৩–১৯৮০)
৪.
ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের হ্যাঁম্পটনে অবস্থিত নাসার ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টার (এল.আর.সি.)-এ আমি কাজ শুরু করলাম। অ্যাডভান্সড অ্যারোস্পেস টেকনোলজির জন্য এটা ছিল প্রাথমিকভাবে একটা আর-অ্যান্ড-ডি সেন্টার। এল.আর.সি.-তে আমার বর্ণবহুল স্মৃতিমালার একটা হচ্ছে একখণ্ড ভাস্কর্য, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একজন রথী দুটো ঘোড়াকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, একটায় ফুটে উঠছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর অন্যটায় প্রযুক্তিগত উন্নতি, তাতে রূপকার্থে প্রকাশ পাচ্ছে গবেষণা ও উন্নয়নের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ।
এল.আর.সি. থেকে আমি গেলাম মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের গ্রিনবেল্টে গরার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার (জি.এস.এফ.সি.)-এ। এই সেন্টারটি নির্মাণ করা হয় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান নাসার অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক উপগ্রহ, সমস্ত মহাশূন্য অভিযানের জন্য নাসার ট্র্যাকিং নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে এই কেন্দ্র। আমার সফরের শেষ দিকে আমি গিয়েছিলাম ভার্জিনিয়ার পূর্ব উপকূলীয় ওয়ালপস আইল্যান্ডে অবস্থিত ওয়ালপস ফ্লাইট ফ্যাসিলিটিতে। এই জায়গাটি ছিল নাসার রকেট কর্মসূচির ঘাঁটি। এখানে আমি দেখতে পেলাম রিসেপশন লবিতে একটা তৈলচিত্র ঝোলান আছে। পশ্চাৎ ভূমিতে কয়েকটা উড়ন্ত রকেটসহ একটা যুদ্ধ ক্ষেত্রের দৃশ্য ছিল তাতে। এই থিম নিয়ে আঁকা তৈলচিত্র কোনো ফ্লাইট ফ্যাসিলিটিতে অতি সাধারণ ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু ছবিটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার কারণ রকেট উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে যে দিক থেকে সে দিককার সৈন্যরা কেউ শ্বেতাঙ্গ ছিল না, তাদের চেহারা ছিল দক্ষিণ এশিয়ার জাতিগুলোর মতো আর তেমনি কালচে চামড়ার। একদিন আমার কৌতূহল চরম মাত্রায় পৌঁছাল, আমাকে টেনে নিয়ে গেল তৈলচিত্রটার কাছে। দেখা গেল ছবিটায় টিপু সুলতানের বাহিনী যুদ্ধ করছে বৃটিশদের সঙ্গে। একটা প্রকৃত ঘটনা, যা টিপুর নিজের দেশ ভুলে গেছে তা প্রকাশিত হচ্ছে এই তৈলচিত্রে আর দুনিয়ার আরেকপ্রান্তে তা স্মরণ করা হচ্ছে। রকেট যুদ্ধের নায়ক হিসাবে একজন ভারতাঁকে যে মহিমান্বিত করেছে নাসা তাতে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম।
আমেরিকানদের সম্পর্কে ধারণার সারসংক্ষেপ করা যায় বেনজামিন ফ্রাংকলিনের একটা কথায়, সেই সব বস্তু যা নির্দেশকে আঘাত করে! আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে দুনিয়ার এই অংশের লোকজন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে। তার মোকাবেলা করে। তারা দুঃখভোগের চেয়ে বরং সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে।