.
বাস্তবের মুখোমুখি হতে আমি অনিচ্ছুক ছিলাম। আমার হৃদয় মন আমি সঁপে দিয়েছিলাম নন্দীতে। আমি হতাশ হয়েছিলাম আর আমার মোহভঙ্গ ঘটেছিল। বিভ্রম ও অনিশ্চয়তার এই সময়টায় শৈশবের স্মৃতি ফিরে এসেছিল আমার কাছে আর সেগুলোর নতুন তাৎপর্য আবিষ্কার করেছিলাম আমি।
পক্ষী শাস্ত্রী বলতেন, সত্য অন্বেষণ করো, সত্য তোমাকে মুক্তি দেবে। বাইবেলে বলা হয়েছে, চাও এবং তুমি পাবে। একদিন ড. মেডিরাট্টা আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাদের হোভারক্র্যাফটের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিলেন। যখন বললাম যে ওড়ার মতো নিখুঁত অবস্থায় যন্ত্রটা রয়েছে, তিনি আমাকে বললেন আগামীকাল গুরুত্বপূর্ণ একজন দর্শনার্থীর জন্য প্রদর্শনের আয়োজন করতে। আমি যতদূর জানতাম, পরের সপ্তাহে কোনো ভিআইপির সফরসূচি ছিল না আমাদের গবেষণাগারে। যা হোক ড. মেডিরাট্টার নির্দেশ আমি পৌঁছে দিলাম আমার সহকর্মীদের কাছে আর আমরা নতুন এক আশার সঞ্চার অনুভব করলাম।
ড. মেডিরাট্টা পরদিন একজন দর্শনার্থীকে নিয়ে এলেন আমাদের হোভারক্র্যাফটের কাছে একজন লম্বা, সুদর্শন, দাড়িওয়ালা লোক। তিনি যন্ত্রটা সম্পর্কে আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তার চিন্তার স্বচ্ছতা ও বিষয়মুখিতায় আমি চমৎকৃত হলাম। আপনি কি আমাকে এই যন্ত্রে চড়াতে পারেন? তিনি জানতে চাইলেন। তার অনুরোধে আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠলাম আমি। শেষ পর্যন্ত, এই একজনকে পাওয়া গেল যিনি আমার কাজে আগ্রহী হলেন।
আমরা দশ মিনিট হোভারক্র্যাফটে চড়লাম, মাটি থেকে কয়েক সেন্টিমিটার ওপরে। আমরা ঠিক উড়ছিলাম না, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বাতাসে ভাসছিলাম। দর্শনার্থী আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন আমার নিজের সম্পর্কে, হোভারক্র্যাফটে চড়ানোর জন্য ধন্যবাদ দিলেন এবং চলে গেলেন। তবে যাবার আগে নিজের পরিচয় : দিয়ে গেলেন তিনি ছিলেন অধ্যাপক এমজিকে মেনন, টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)-এর পরিচালক। এক সপ্তাহ পর, আমার কাছে একটা ফোন এল ইন্ডিয়ান কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ (ইনকপার) থেকে। রকেট ইঞ্জিনিয়ারের একটা পোস্টে আমাকে ইন্টারভিউ দিতে ডাকা হলো। সেই সময়ে আমি ইনকসপার সম্পর্কে যা জানতাম তা হলো, বোম্বাইতে (এখন মুম্বাই) টিআইএফআর-এর ট্যালেন্ট পুল নিয়ে গঠিত একটা কমিটি, ভারতে মহাকাশ গবেষণা সংগঠিত করার জন্য যার উদ্ভব।
ইন্টারভিউতে হাজির হতে আমি বোম্বাই গেলাম। ইন্টারভিউতে আমাকে যে সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে সে সবের ধরন সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। এ নিয়ে পড়াশোনা করার অথবা অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার মতো সময় ছিল না হতে। লক্ষ্মণা শাস্ত্রীর কণ্ঠে ভগবৎ গীতা প্রতিধ্বনিত হলো আমার কানে:
সকল প্রাণী দ্বিত্বের মোহ নিয়ে জন্মায়…. অভিভূত থাকে কামনা ও ঘৃণা থেকে উত্থিত দ্বিত্বের দ্বারা…. কিন্তু যাদের মধ্যে পাপ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যারা দ্বিত্বের প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত, তারা স্থিরচিত্তে আমার উপাসনা করে।
আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলাম যে বিজয়ী হওয়ার সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে বিজয়ী হওয়ার দরকার নেই মনে করা। তুমি যখন স্বাভাবিক আর সন্দেহ মুক্ত থাকবে, তখনই তুমি ভালো ফলাফল করতে পারবে। ঘটনা যেভাবে ঘটবে সেভাবেই নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। যেন অধ্যাপক এমজিকে মেননের সফর কিংবা ইন্টারভিউতে হাজির হবার জন্য টেলিফোন ইত্যাদিতে আমার কিছু যায় আসে না, এটাই সর্বোত্তম মনোভাব হবে বলে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমার ইন্টারভিউ নিলেন ড. বিক্রম সারাভাই, তার সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক এমজিকে মেনন এবং তৎকালীন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের ডেপুটি সেক্রেটারি মি. শরাফ। কামরায় যখন আমি প্রবেশ করলাম, তখনই তাদের উষ্ণতা ও বন্ধুসুলভ মনোভাব আমি অনুভব করতে পারলাম। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে ড, সারাভাইয়ের উষ্ণতায় আমি চমৎকৃত হলাম। ইন্টারভিউ গ্রহণকারীরা সাধারণত যেমন অহংকার ও পৃষ্ঠপোষকসুলভ মনোভাব দেখিয়ে থাকে কোনো তরুণ ইন্টারভিউ প্রদানকারীর সঙ্গে তার কোনো চিহ্নই ছিল না সেখানে। ড, সারাভাইয়ের প্রশ্ন আমার বিদ্যমান জ্ঞান ও দক্ষতা খুঁড়ে তুলল না; বরং তারা ব্যস্ত ছিলেন যে সম্ভাবনা আমি ধারণ করি নিজের মধ্যে তা আবিষ্কার করায়। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে যেন আরও বড়ো কিছু সন্ধান করছিলেন। পুরো সাক্ষাৎকারের বিষয়টি আমার কাছে মনে হলো সত্যের সামগ্রিক এক মুহূর্ত, যার মধ্যে আমার স্বপ্ন বড়ো এক ব্যক্তির বড়ো এক স্বপ্নে আবৃত ছিল।
আমাকে পরামর্শ দেওয়া হলো কয়েক দিন থেকে যাবার জন্য। যাহোক, পরদিন সন্ধ্যায় আমাকে নির্বাচন করার কথা জানান হলো। রকেট ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আমাকে আত্মভূত করা হবে ইনকসপারে। ঠিক এই রকম একটা ব্রেকথ্রর স্বপ্নই দেখে আমার মতো কোনো তরুণ।
ইনকাসপারে আমার কাজ শুরু হলো টিআইএফআর কম্পিউটার সেন্টারে পরিচিতিমূলক কোর্সে। এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এর পরিবেশ থেকে। লেবেল কোনো বিষয় ছিল না। নিজের পজিশন জাহির। করার কিংবা অন্যদের প্রতিকূলতার বস্তু হওয়ার প্রয়োজন ছিল না কারো।
১৯৬২ সালের দ্বিতীয়ার্ধের কোনো সময়ে ইনকসপার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, থুম্বায় একটা ইকুয়ারিয়াল রকেট লঞ্চিং স্টেশন স্থাপন করা হবে। থুম্বা ছিল কেরালা রাজ্যের অন্তর্গত ত্রিবান্দ্রাম (এখন থিরুভানাথাপুরাম)-এর নিকটবর্তী মৎস্যজীবীদের নিঝুম এক গ্রাম। আহমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির ড, চিটনিস এ জায়গাটিকে উপযুক্ত লোকেশন হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, কারণ এ জায়গাটি ছিল পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ইকুয়াটরের অত্যন্ত সন্নিকটে। ভারতে আধুনিক রকেট-ভিত্তিক। গবেষণার এই ছিল সূচনা। থুম্বায় নির্বাচিত স্থানটির অবস্থান ছিল রেললাইন ও সমুদ্র উপকূলের মাঝখানে, প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং মাপে প্রায় ৬০০ একর। এই এলাকার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল একটা বিশাল গির্জা, সেই জায়গাটাও অধিগ্রহণের দরকার ছিল। ব্যক্তিগত পক্ষের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ সবসময়ই অসুবিধাজনক। আর কালক্ষেপণের ব্যাপার, বিশেষ করে কেরালার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। এর ওপর আরও সমস্যা, ধর্মীয় স্থান অধিগ্রহণ। ত্রিবান্দ্রামের তৎকালীন কালেক্টর কে, মাধবন নায়ার দারুণ কৌশলে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছিলেন। রাইট রেভারেন্ড ড, ডেরেইরার আশীর্বাদ ও সহযোগিতা নিয়ে তিনি সমস্যার সমাধান বের করে দেন।