ঐ সময় ভিকে কৃষ্ণ মেনন ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। আমাদের ক্ষুদ্র প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত উৎসাহিত ছিলেন, এই বিষয়টিকে তিনি মনে করতেন ভারতের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের উন্নয়ন কাজের সূচনা হিসাবে। ব্যাঙ্গালোরে যখনই তিনি আসতেন তখনই তিনি কিছুটা সময় বের করে নিতেন আমাদের প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য। আমাদের সামর্থ্যের ব্যাপারে তার আস্থা আমাদের ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল। অ্যাসেম্বলি শপে আমি প্রবেশ করতাম আমার অন্যান্য সমস্যা বাইরে রেখে, ঠিক আমার বাবা নামাজ পড়ার জন্য যেভাবে মসজিদে প্রবেশ করতেন, বাইরে রেখে আসতেন তার জুতো।
কিন্তু জিইএম সম্পর্কে কৃষ্ণ মেননের মতামত প্রত্যেকেই যে গ্রহণ করেছিল তা নয়। সহজলভ্য যন্ত্রাংশ দিয়ে আমাদের এই এক্সপেরিমেন্ট উৎফুল্ল করতে পারেনি আমাদের সিনিয়র সহকর্মীদের। এমনকি অনেকেই আমাদের বলতেন খামখেয়ালি উদ্ভাবকদের একটি দল যারা দৌড়াচ্ছে অসম্ভব এক স্বপ্নের পেছনে। navvie-দের নেতা হওয়ায় আমি ছিলাম নির্দিষ্টভাবে তাদের লক্ষ্যবস্তু। আমাকে গণ্য করা হয়েছিল একজন অমার্জিত পেঁয় লোক হিসাবে যে কিনা বিশ্বাস করে যে বাতাসে আরোহণ ছিল তার করায়ত্ত। আমাদের বিরুদ্ধ মতামতের ভার আমার চির-আশাবাদী মনকে আরও বেশি জোরালো করেছিল। এডিই-তে কয়েকজন সিনিয়র বিজ্ঞানীর মন্তব্যে আমার মনে পড়ত ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত রাইট ভাইদের নিয়ে লেখা জন ট্টোব্রিজ-এর বিখ্যাত স্যাটায়ার কবিতার কিছু অংশ:
…with thimble and thread
And wax and hammer, and buckles and screws,
And all such things as geniuses use;
Two bats for patterns, curious fellows!
A charcoal-Pot and a pair of bellows.
.
প্রকল্পটা যখন প্রায় এক বছর অতিক্রম করেছে, তখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন এডিইতে তার একটা রুটিন পরিদর্শনে এলেন। আমি তাকে আমাদের অ্যাসেম্বলি শপে নিয়ে এলাম। ভেতরে একটা টেবিলের ওপর রাখ ছিল জিইএম মডেলটি। যুদ্ধের ময়দানের জন্য বাস্তবসম্মত একটা হোভারক্র্যাফট তৈরির এক বছরের অক্লান্ত চেষ্টার প্রতিফলন ঘটেছিল তাতে। মন্ত্রী একটার পর একটা প্রশ্ন করলেন আমাকে। আগামী বছরের মধ্যেই এই প্রটোটাইপ টেস্ট ফ্লাইটে যাবে তা নিশ্চিত হতে তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন। তিনি ড. মেডিরাট্টাকে বলেছিলেন, কালাম যে গ্যাজেট অধিকার করেছে তার সাহায্যে জিইএম ফ্লাইট সম্ভব।
হোভারক্র্যাফটের নামকরণ করা হয়েছিল নন্দী, শিবের বাহন সঁড়ের নামানুসারে। একটা প্রটোটাইপের ক্ষেত্রে, এর আকার, যোগ্যতা ও পূর্ণতা ছিল আমাদের প্রত্যাশার বাইরে, আমরা একটা অবকাঠাম পেয়েছিলাম। আমার সহকর্মীদের আমি বললাম, এই যে একটা ফ্লাইং মেশিন, এটা নির্মাণ করেছে একদল বাতিকগ্রস্ত ব্যক্তি নয় বরং দক্ষ প্রকৌশলীরা। এটার দিকে তাকিয়ে থেকো না। তাকিয়ে থাকার জন্য এটা তৈরি করা হয়নি, এটা তৈরি করা হয়েছে ওড়ার জন্য।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন নন্দীতে চড়ে আকাশ বিহার করলেন, তার সঙ্গে ছিল নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা। মন্ত্রীর দলে একজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিলেন, কয়েক হাজার ঘন্টা আকাশে ওড়ার রেকর্ড ছিল তার লগ বুকে। আমার মতো অনভিজ্ঞ এক বেসামরিক পাইলটের সঙ্গে ওড়ার সম্ভাব্য বিপদ থেকে মন্ত্রীকে রক্ষা করতে নিজেই ফ্লাইং মেশিনটা চালানোর প্রস্তাব দিলেন তিনি, আর ইশারা করলেন যন্ত্রটা থেকে আমাকে বেরিয়ে আসার জন্য। আমার তৈরি যন্ত্রটা ঠিকভাবে ওড়াতে পারার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম, সুতরাং আপত্তি জানিয়ে আমি মাথা নাড়লাম। এই শব্দহীন কথাবার্তা লক্ষ করে মেনন একটা হাসি দিয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেনের অপমানকর প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন এবং যন্ত্রটা চালানোর সংকেত দিলেন আমাকে। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন।
হোভারক্র্যাফট উন্নতির মূল সমস্যা সমাধান করা গেছে তা তুমি দেখিয়েছ। আরও শক্তিশালী একটা প্রাইম মুভার তৈরি কর আর তাতে দ্বিতীয়বার চড়ার জন্য আমাকে ডাক দিও, কৃষ্ণ মেনন আমাকে বললেন। সন্দেহবাদী গ্রুপ ক্যাপ্টেন (এখন এয়ার মার্শাল) গোলে পরবর্তীকালে আমার এক ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন।
নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রকল্প সম্পূর্ণ করলাম আমরা। আমাদের সঙ্গে ছিল একটা ওয়ার্কিং হোভারক্র্যাফট, প্রায় ৪০ মিমি এয়ার কুশন আর ৫৫০ কেজি লোড নিয়ে চলছিল সেটা, সেই সঙ্গে কড়তার ওজন। ড. মেডিরাট্টা দৃশ্যত এই সাফল্যে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এই সময়ে কৃষ্ণ মেননের মন্ত্রীত্ব শেষ হয়ে গেল, ফলে তার প্রতিশ্রুত দ্বিতীয়বার ফ্লাইং মেশিনে চড়তে পারলেন না। একটা দেশীয় হোভারক্র্যাফট সামরিক বাহিনীতে সংযোজন করার যে স্বপ্ন তার ছিল, সে স্বপ্ন অনেকেরই ছিল না। প্রকৃত পক্ষে, এমনকি আজও, হোভারক্র্যাফট আমদানি করতে হয় আমাদের মতোবিরোধের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। আমার জন্য এটা ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। যত দূর আমার ধারণা ছিল যে আকাশ পর্যন্ত হচ্ছে সীমা, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সীমা আরও নিকটের ব্যাপার। কিছু বাউন্ডারি আছে যা নির্দেশ দেয় জীবনকে এতটা ওজন তুমি তুলতে পার; এতটা দ্রুত তুমি শিখতে পার; এতটা পরিশ্রমের সঙ্গে তুমি কাজ করতে পার; এতটা দূর তুমি যেতে পার।