এমনকি সেই সব দিনেও কানপুর ছিল ঘনবসতিপূর্ণ নগরী। কোনো শিল্পনগরীতে বসবাসের সেটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। ঠান্ডা আবহাওয়া, জনমানুষের ভিড়, হৈ চৈ আর ধোয়া ইত্যাদি ছিল, তার সম্পূর্ণ বিপরীত রামেশ্বরমে যাতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম। সবচেয়ে ঝামেলার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম সকালের নাশতা থেকে রাতের খাবার পর্যন্ত ডাইনিং টেবিলে আলুর অবিরাম উপস্থিতিতে। আমার কাছে এটা ছিল এই নগরীতে একাকীত্বের অনুভূতির মতো। রাস্তায় যেসব লোকজন চোখে পড়ত তারা সবাই গ্রাম থেকে এসেছিল কারখানাগুলোয় কাজের সন্ধানে, পরিবারের সুরক্ষা আর তাদের মাটির গন্ধ ফেলে এসেছিল তারা পেছনে।
দিল্লিতে আমার প্রত্যাবর্তনে আমাকে জানান হলো যে একটা DART টার্গেটের নকশা গ্রহণ করা হয়েছে ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এ এবং ডিজাইন টিমে আমাকে রাখা হয়েছে। আমি এই কাজ শেষ করলাম দলের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মিলে। তারপর একটা Humall Centrifuge-এর প্রাথমিক নকশার কাজ নিলাম। পরে ভার্টিক্যাল টেকঅফ ও ল্যান্ডিং প্ল্যাটফর্ম-এর নকশা তৈরি ও উন্নয়নের কাজ করলাম। হট ককপিট-এর উন্নয়ন ও নির্মাণের কাজেও আমি সহযোগিতা করি। তিন বছর পেরিয়ে গেল। তারপর ব্যাঙ্গালোরে জন্ম নিল দ্য অ্যারোনটিক্যাল ডেভলপমেন্ট এস্টাবলিশমেন্ট (এডিই) এবং নতুন এই প্রতিষ্ঠানে আমাকে বদলি করা হলো।
.
নগর হিসাবে ব্যাঙ্গালোর সরাসরি বিপরীত ছিল কানপুরের। বস্তুত, আমি অনুভব করি আমাদের দেশের একটা অতিপ্রাকৃত ধরনের পন্থা আছে তার জনগণের চরমসীমা বের করে আনার। আমার ধারণা, এর কারণ ভারতীয়রা অনেক শতাব্দীর অভিবাসনে সমৃদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন শাসকের প্রতি আনুগত্য আমাদের একক বশ্যতার ক্ষমতা হরণ করেছে। পরিবর্তে আমরা যুগপৎ একই সঙ্গে অর্জন করেছি সহমর্মিতা ও নিষ্ঠুরতা, সংবেদশীলতা ও নির্মমতা, গভীরতা ও তরলতার এক অনন্যসাধারণ সামর্থ্য। অনভিজ্ঞ দৃষ্টিতে আমরা বর্ণবহুল ও ছবিতুল্য বলে প্রতিভাত হতে পারি; কিন্তু সমালোচকের চোখে, আমাদের বিভিন্ন প্রভুর বাজে রকম নকল ছাড়া আর কিছু নয়। কানপুরে আমি দেখেছিলাম পান চিবানো ওয়াজিদ আলী শাহ-এর নকল, এবং ব্যাঙ্গালোরে এর বিপরীতে কুকুর নিয়ে হাঁটা সাহেবদের। এখানেও আমি ব্যাকুল হয়ে পড়লাম রামেশ্বরমের গভীরতা ও শান্ততার জন্য। পার্থিব ভারতীয়ের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের মধ্যে সম্পর্ক ক্ষয় হয়ে গেছে আমাদের নগরসমূহের বিভক্ত স্পর্শকাতরতার দ্বারা। আমার সন্ধ্যাগুলো আমি কাটাতাম ব্যাঙ্গালোরের শপিং রাজা আর বাগানগুলো আবিষ্কার করে।
প্রথম বছরে এডিইতে কাজের চাপ অনেক হালকা ছিল। প্রথমে আমার মধ্যে কাজের ধারা সঞ্চার করতে হয়েছিল, যে পর্যন্ত না ক্রমান্বয়ে ছন্দ সৃষ্টি হয়। গ্রাউন্ডহ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট বিষয়ক আমার প্রাথমিক অধ্যয়নের ভিত্তিতে একটা প্রকল্প দল গঠন করা হলো, একটা গ্রাউন্ড ইকুইপমেন্ট মেশিন (জিইএম) হিসাবে একটা দেশীয় হোভারক্র্যাফট প্রটোটাইপ-এর নকশা ও উন্নয়ন কাজের জন্য। সেটা ছিল একটা ক্ষুদে কর্মীদল। চারজন সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্টকে নিয়ে এডিইর পরিচালক ড. ওপি মেডিরাট্টা আমাকে দলের নেতৃত্ব দিতে বললেন। ইঞ্জিনিয়ারিং মডেল তৈরির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হয়েছিল আমাদের।
যে কোনো মানের দিক থেকে প্রকল্পটা ছিল আমাদের যৌথ সামর্থ্যের চেয়েও অনেক বড়ো। আমাদের কারোরই যন্ত্র তৈরির অভিজ্ঞতা ছিল না, ফ্লাইং মেশিন তৈরি তো দূরের কথা। কোনো ডিজাইন বা প্রতিরূপ ছিল না যার সাহায্য নিয়ে আমরা শুরু করতে পারি। আমরা শুধু জানতাম যে আমাদেরকে একটা বাতাসের চেয়ে ভারী ফ্লাইং মেশিন তৈরি করতে হবে। হোভারক্র্যাফট বিষয়ক যত কিছু লেখালেখি ছিল সব সংগ্রহ করে আমরা পড়ি, কিন্তু এ বিষয়ে খুব লেখালেখি ছিল না। এক্ষেত্রে যাদের জ্ঞান আছে এমন লোকদের পরামর্শ নেওয়ার চেষ্ট করি আমরা, কিন্তু তেমন কাউকেই খুঁজে পাই না। একদিন সীমিত তথ্য ও সূত্র নিয়ে কাজে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।
একটা ডানাবিহীন, হালকা, দ্রুতগতির মেশিন তৈরির এই প্রচণ্ড চেষ্টা খুলে দিলো আমার মনের জানালা। আমি খুব দ্রুত দেখতে পেয়েছিলাম একটা হোভারক্র্যাফট ও একটা এয়ারক্র্যাফট-এর মধ্যে প্রতীকি যোগসূত্র। সে যাই হোক, সাত বছর ধরে বাইসাইকেল ফিক্সিং করার পর প্রথমবারের মতো এরোপ্লেন তৈরি করতে পেরেছিলেন রাইট ভাইয়েরা! জিইএম প্রকল্পে উদ্ভাবনী দক্ষতা ও ক্রমোন্নতির বিশাল সুযোগ দেখতে পেয়েছিলাম আমি। ড্রইং বোর্ডের ওপর কয়েক মাস কাটানোর পর আমরা সরাসরি হার্ডওয়্যার কাজে আত্মনিয়োগ করি।
আমার মতো পটভূমির কোনো ব্যক্তির যে পটভূমি হচ্ছে পল্লী অঞ্চল কিংবা ক্ষুদে শহর, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বাবা-মায়ের সীমিত শিক্ষা, তো এ রকম একটি পটভূমির কোনো ব্যক্তির সবসময় যা বিপদ তা হলো সে একটা কোণে পশ্চাদপসরণ করবে এবং শুধু অস্তিত্বের জন্যই সেখানে সংগ্রাম করবে, যতক্ষণ না বড়ো কোনো ঘটনা তাকে চালিত করে আরও অধিক অনুকূল পরিবেশের মধ্যে। আমি জানতাম আমাকেই আমার নিজের সুযোগগুলো তৈরি করে নিতে হবে।
অংশের পর অংশ, সাবসিস্টেমের পর সাবসিস্টেম, স্তরের পর স্তর কাজ এগিয়ে চলল। এই প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে আমি শিখলাম যে, একবার যদি তোমার মন একটা নতুন সুরে প্রসারিত হয় তাহলে আর কখনও তা আগের মাত্রায় ফিরে যাবে না।