আমি এক সপ্তাহের যাত্রা বিরতি করলাম দিল্লিতে, মহান সুফী সাধক হযরত নিজামুদ্দিনের এই নগর। সেখানে ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এ ইন্টারভিউ দিলাম। আমার ইন্টারভিউ ভালোই হলো। রুটিন মাফিক কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল আমাকে, আর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার জ্ঞান সম্পর্কে কোনো প্রশ্নই তোলা হয়নি। তারপর আমি দেরাদুন গেলাম এয়ার ফোর্স সিলেকশন বোর্ডের সামনে আমার ইন্টারভিউ দিতে। সিলেকশন বোর্ডে মেধার চেয়ে ব্যক্তিত্বের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলো বেশি। হয়তো তারা অনুসন্ধান করছিল শারীরিক যোগ্যতা আর স্পষ্ট আচরণ। আমি বেশ উত্তেজিত কিন্তু নার্ভাস হয়েছিলাম, দৃঢ়প্রত্যয়ী কিন্তু উদ্বিগ্ন ছিলাম। এয়ার ফোর্সে আটজন অফিসার নির্বাচন করার জন্য ২৫ জনের ব্যাচে আমি নবম স্থান পেলাম। আমি দারুন হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। বিমান বাহিনীতে যোগ দেবার সুযোগ আমার আঙলের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে তা উপলব্ধি করতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। সিলেকশন বোর্ড থেকে বেরিয়ে এসে একটা পাহাড় চূড়ায় দাঁড়ালাম আমি। অনেক নিচে একটা হ্রদ দেখা যাচ্ছিল। আমি জানতাম সামনের দিনগুলো আরও সংকটময় হবে। প্রশ্ন ছিল যার উত্তর দিতে হবে এবং কর্মপরিকল্পনা যা প্রস্তুত করতে হবে। আমি সোজা চলে গেলাম ঋষিকেশ।
.
আমি গঙ্গায় স্নান করে এর জলের পবিত্রতায় পরমানন্দ লাভ করলাম। তারপর পায়ে হেঁটে এলাম শিবানন্দ আশ্রমে, পাহাড়ের খানিকটা উঁচুতে সেটা অবস্থিত। ভেতরে ঢোকার সময় আমি প্রচণ্ড কম্পন অনুভব করলাম। বিপুল সংখ্যক সাধুকে দশাপ্রাপ্ত অবস্থায় উপবিষ্ট দেখলাম চারপাশে। বইতে পড়েছিলাম যে সাধুরা হচ্ছে আধ্যাত্মিক মানুষ যারা স্বজ্ঞালব্ধভাবে সবকিছু জানে। বিষণ্ণ মনে যে সন্দেহগুলো আমাকে জ্বালাতন করত তার জবাব খুঁজতাম আমি।
আমি সাক্ষাৎ করলাম স্বামী শিবানন্দের সঙ্গে। বুদ্ধের মতো দেখতে মানুষটা, পরে আছে তুষারধবল ধুতি আর কাঠের খড়ম। জলপাইয়ের মতো তার গায়ের রং এবং কালো চোখ। তার অপ্রতিরোধ্য এবং প্রায় শিশুসুলভ হাসি আর মহিমান্বিত ব্যবহারে আমি চমকিত হলাম। স্বামীজীর কাছে আমি নিজের পরিচয় দিলাম। আমার মুসলিম নাম তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল না। আমি আর কিছু বলার আগেই তিনি আমার দুঃখের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমার দুঃখ তিনি কীভাবে জানলেন তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিলেন না আর আমিও জানতে চাইলাম না।
বিমান বাহিনীতে যোগদানের আমার ব্যর্থ চেষ্টার কথা তাকে বললাম। তিনি মৃদু হাসলেন, প্রায় তৎক্ষণাৎ মুছে দিলেন আমার সকল উদ্বিগ্নতা। তারপর তিনি মৃদু কিন্তু অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন,
আকাঙ্ক্ষা, যখন তার উদ্ভব ঘটে হৃদয় ও আত্মা থেকে, যখন তা বিশুদ্ধ ও প্রগাঢ়, তখন তাকে আচ্ছন্ন করে ভীষণ বিদ্যুৎচুম্বকীয় শক্তি। এই শক্তি প্রতি রাতে নিষ্কাষিত হয় ইথারে, মন যখন নিদ্রার স্তরে থাকে। প্রতি সকালে তা চেতন স্তরে ফিরে আসে মহাজাগতিক প্রবাহের নতুন শক্তি নিয়ে। যা কল্পনা করা হয়েছে তা নিশ্চিত ভাবেই প্রতীয়মান হবে। তুমি নির্ভর করতে পারো, যুবক, এই অনন্ত প্রতিশ্রুতির ওপর যেমন নিশ্চিতভাবে তুমি নির্ভর করতে পারো চিরন্তনভাবে অটুট সূর্যোদয়ের… এবং বসন্তের প্রতিশ্রুতির ওপর।
ছাত্র যখন তৈরি, তখন শিক্ষকের আগমন ঘটবে-কী সত্যি! এই তো এক শিক্ষক যিনি পথ দেখাচ্ছেন এক ছাত্রকে যে কিনা প্রায় বিপথে যেতে বসেছিল। তোমার নিয়তিকে গ্রহণ করো আর জীবনকে নিয়ে এগিয়ে চল। বিমান বাহিনীর পাইলট হওয়ার ভাগ্য নয় তোমার। তুমি কী হবে তার নিয়তি এখনও উন্মোচিত নয়, কিন্তু আগেই তা নির্দিষ্ট হয়ে আছে। এই ব্যর্থতার কথা ভুলে যাও, মনে করো তোমার নিয়তি নির্দিষ্ট পথে চলার জন্য এ ছিল অপরিহার্য। এর পরিবর্তে তোমার অস্তিত্বের আসল উদ্দেশ্য অনুসন্ধান কর। নিজেকে সমর্পন কর ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে, স্বামীজী বললেন।
আমি দিল্লিতে ফিরে এলাম এবং আমার ইন্টারভিউয়ের ফলাফল জানার জন্য ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এ খোঁজ নিলাম। জবাবে আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো নিয়োগপত্র। মাসিক ২৫০ রূপি মূল বেতনে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে পরদিন সেখানে আমি কাজে যোগদান করলাম। যদি এই আমার নিয়তি হয়ে থাকে, আমি ভাবলাম, তাহলে তাই হোক। শেষ পর্যন্ত, মানসিক শান্তিতে আমি পূর্ণ হলাম। বিমান বাহিনীতে ঢুকতে না-পারার ব্যর্থতায় আমার মনে আর কোনো তিক্ততা ছিল না। এসব ছিল ১৯৫৮ সালের ঘটনা।
ডাইরেক্টরেটে আমাকে নিয়োগ করা হলো টেকনিক্যাল সেন্টার (এভিয়েশন) এ। আমি যদি এরোপ্লেনে উড়তে নাই পারি, অন্তত সেগুলো ওড়াতে সাহায্য করতে পারব। ডাইরেক্টরেটে আমার প্রথম বছরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আর ভরদরাজনের সহযোগিতায় সুপারসনিক টার্গেট এয়ারক্রাফটের ওপর একটা নকশার কাজ করেছিলাম আমি। পরিচালক ড. নীলকান্তন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন আমার কাজের। বিমান রক্ষণাবেক্ষণের শপ-ফ্লোর এক্সপোজারের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠান হলো কানপুরে এয়ারক্র্যাফট অ্যান্ড আর্মামেন্ট টেস্টিং ইউনিট (এঅ্যান্ডএটিইউ)-এ। ওই সময় তারা Gnat Mk1 বিমানের ট্রপিক্যাল ইভ্যালুয়েশন এ জড়িত ছিল। এর অপারেশন সিস্টেমের মূল্যায়ন কাজে আমি অংশগ্রহণ করি।