প্রকল্প কালের বাকি সময়ে এমআইটি তামিল সংঘম (সাহিত্য সমাজ) আয়োজিত এক রচনা প্রতিযোগিতায় আমি অংশগ্রহণ করি। তামিল আমার মাতৃভাষা, এবং এর উত্স নিয়ে আমি গর্বিত, যার গতিপথ অনুসরণ করলে রামায়ণপর্ব কালের মহামনি অগস্ত্য পর্যন্ত পৌঁছান যাবে; এ ভাষায় রচিত সাহিত্য খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দির পুরনো। এই চমৎকার ভাষার আওতার বাইরে বিজ্ঞান থাকতে পারে না তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমি অতিশয় প্রত্যয়ী ছিলাম। আমি তামিলে একটা প্রবন্ধ লিখি আমাদের নিজস্ব বিমান তৈরি করা যাক শিরোনামে। প্রবন্ধটি দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং প্রতিযোগিতায় আমি। বিজয়ী হই। জনপ্রিয় তামিল সাপ্তাহিক আনন্দ বিকাতান-এর সম্পাদক দেবন এর কাছ থেকে আমি প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করি।
এমআইটি-তে আমার সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী স্মৃতি অধ্যাপক স্পন্ডারের সঙ্গে জড়িত। বিদায় অনুষ্ঠানের অংশ হিসাবে আমরা গ্রুপ ছবি ওঠাচ্ছিলাম। সামনে উপবিষ্ট অধ্যাপকদের রেখে সকল স্নাতক ছাত্র তিন সারিতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অধ্যাপক স্পন্ডার হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে খুঁজতে লাগলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তৃতীয় সারিতে। সামনের সারিতে এসে আমার পাশে বসো, তিনি বললেন। অধ্যাপক স্পন্ডারের আমন্ত্রণে আমি হতচকিত হয়ে পড়লাম। তুমি আমার সেরা ছাত্র এবং ভবিষ্যতে তোমার শিক্ষকদের বিপুল সুনাম বয়ে আনতে কঠোর পরিশ্রম তোমাকে সাহায্য করবে। প্রশংসায় বিহ্বল কিন্তু স্বীকৃতিতে সম্মানিত হয়ে ছবি তোলার জন্য আমি বসলাম অধ্যাপক স্পন্ডারের পাশে। ঈশ্বর তোমার আশা, তোমার বেঁচে থাকা, তোমার পথ প্রদর্শক হোন, আর তিনি ভবিষ্যতে তোমার চলার পথে আলো দিন, অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষটি এভাবে আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন।
এমআইটি থেকে ট্রেইনি হিসাবে আমি গেলাম ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (এইচএএল)-এ। সেখানে একটা দলের অংশ হিসাবে আমি ইঞ্জিন ওভারলিং-এর কাজ করতাম। বিমানের ইঞ্জিন ওভারহলিং বিষয়ে খোলা হাতের কাজ ছিল অত্যন্ত শিক্ষামূলক। ক্লাসরুমে শেখা কোনো নিয়ম যখন ফলবতী হয় বাস্তব অভিজ্ঞতায়, তখন তা থেকে সৃষ্টি হয় উত্তেজনার এক অদ্ভুত অনুভূতি যেন একদল অচেনা মানুষের মধ্যে পুরনো বন্ধুকে দেখতে পেয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে তার দিকে দৌড়ানো। এইচএএলে পিস্টন আর টারবাইন ইঞ্জিন উভয়ের ওভারহলিং-এর কাজ করতাম আমি। গ্যাস ডাইনামিকস-এর আবছা ধারণা আর আফটার বানিং বিষয়ক নিয়মের বিভাজন প্রক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল আমার মনে। আমি রেডিয়াল ইঞ্জিন-কাম-ড্রাম পরিচালনার প্রশিক্ষণও পেয়েছিলাম।
আমি শিখেছিলাম ওয়্যার ও টিয়ারের জন্য একটা ক্র্যাংকশ্যাফট কীভাবে চেক করতে হয়; আর টুইস্টের জন্য ক্র্যাংকশ্যাফট ও একটা সংযোগ বড়ো। একটা সুপার-চার্জড় ইঞ্জিনে যুক্ত একটা ফিক্সড-পিচ ফ্যানের ক্রমাংকন করি আমি। প্রেসার ও এক্সিলারেশন-কাম-স্পিড কন্ট্রোল সিস্টেম খুলে দিই, এবং টার্বো-ইঞ্জিনের এয়ার স্টার্টার সাপ্লাই সিস্টেমস। প্রপেলার ইঞ্জিনের রিভার্সিং এবং ফেদারিং ও আন ফেদারিং বুঝতে পারা ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। এইচএএল-এর টেকনিশিয়ানদের বেটা (ব্লেড অ্যাঙ্গল কন্ট্রোল)-এর নিখুঁত শিল্প এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। বড়ো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না, তাদের ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার যার নির্দেশ দিচ্ছিল তার বাস্তবায়নও করছিল না তারা। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা খোলা হাতে কাজ করছিল এবং এটাই তাদের কাজ করার এক অনুভূতি জাগিয়েছিল।
এইচএএল থেকে একজন গ্রাজুয়েট অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে বেরিয়ে আসার পর কাজের দুটো বিকল্প সুযোগ ছিল আমার সামনে, দুটোই আকাশে ওড়ার আমার দীর্ঘ দিনের স্বপ্নের কাছাকাছি। একটা এয়ার ফোর্সে এবং অন্যটি ডাইরেক্টরেট অব টেকনিক্যাল ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড প্রডাকশন ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার)-এ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। দুটোতেই আমি আবেদন করলাম। প্রায় যুগপৎ দুটো জায়গা থেকেই ডাকা হলো সাক্ষাৎকারের জন্য। এয়ার ফোর্স রিক্রুটমেন্ট কর্তৃপক্ষ আমাকে ডেকে পাঠাল দেরাদুনে আর ডিটিডিঅ্যান্ডপি (এয়ার) দিল্লিতে। করোমন্ডল উপকূলের বালকটি উত্তর ভারত অভিমুখী একটা ট্রেন ধরেছিল। আমার গন্তব্য ছিল ২০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। আর আমার মাতৃভূমির বিস্তীর্ণতা দেখার সুযোগও হলো আমার সেই প্রথম।
.
৩.
কম্পার্টমেন্টের জানলা দিয়ে আমি দেখতে লাগলাম দ্রুত ধাবমান পল্লী অঞ্চল। ক্ষেত-খামারে শাদা ধুতি ও পাগড়ি পরা পুরুষেরা, আর ধান ক্ষেতের সবুজ পটভূমিতে বর্ণবহুল পোশাক পরিহিতা নারীদের দেখে মনে হচ্ছিল চমৎকার তৈলচিত্রের দৃশ্যের মতো। জানলায় আমি বসে ছিলাম আঠার মতো। প্রায় সবখানেই লোকজন কোনো না কোনো কাজে লিপ্ত ছিল, আর তাতে ছিল ছন্দ ও শান্তিপূর্ণতা। পুরুষেরা তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গবাদি পশু, ঝর্ণা থেকে পানি আনছে নারীরা। কোনো কোনো সময় হয়তো একটা বাচ্চার আবির্ভাব ঘটছে আর সে হাত নাড়ছে ট্রেনের উদ্দেশ্যে।
ক্রমাগত উত্তরের দিকে যেতে যেতে যেভাবে ভূদৃশ্যের পরিবর্তন ঘটে তা বিস্ময়কর। গঙ্গা নদীর দুপাশে সমৃদ্ধ সমতল উর্বর ভূমি শিকার হয়েছে আগ্রাসন, ক্ষয়ক্ষতি ও পরিবর্তনের। প্রায় ১৫০০ খৃস্টপূর্বাব্দে উত্তরপশ্চিমের পর্বত পেরিয়ে এ অঞ্চলে এসেছিল গৌরবর্ণের আর্যরা। দশম শতাব্দীতে এসেছিল মুসলমানরা, পরে যারা স্থানীয় অধিবাসীদের ভেতর মিশে গিয়েছিল আর এ দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। এক সাম্রাজ্য হটিয়ে দিয়েছিল অন্য সাম্রাজ্যকে ধর্মীয় বিজয় অভিযান অব্যাহত ছিল। এই পুরো সময়ে কর্কটক্রান্তির দক্ষিণে ভারতের এই অংশ বেশির ভাগটাই থেকে গিয়েছিল অস্পষ্ট, বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বত শ্রেণির আড়ালে নিরাপদ। নর্মদা, তপ্তি, মহানদী, গোদাবরি ও কৃষ্ণ নদী ভারতীয় উপদ্বীপের জন্য নিরাপত্তা রক্ষার জাল বিছিয়েছিল। আমাকে দিল্লিতে নিয়ে যাবার জন্য ট্রেনটা অতিক্রম করে গেল এসবকিছু।